October 21, 2024

স্মরণে শ্রদ্ধায় ১৩ এপ্রিল মনে রবে চিরকাল।

1 min read


জয়ন্ত বোস, বর্তমানের কথা।(সংগৃহীত প্রতিবেদন  আজ ১৩ই এপ্রিল ২০১৯ .মনে করিয়ে দেই একটি জঘন্যতম  ঘটনা। জালিয়ানওয়ালাবাগ  দাগগুলো আজও রয়ে গেছে দেয়ালের গায়ে। ইঁটের মাঝে বুলেটের গভীর ক্ষত। আর রয়ে গেছে সেই রক্তাক্ত স্মৃতি, ভয়ঙ্কর সে ইতিহাস। এক ঝলকে খুলে গিয়েছিল ব্রিটিশের সভ্যতার মুখোশ। সাম্রাজ্যবাদের রক্তলোলুপ চরিত্রটা স্পষ্ট হয়েছিল বিশ্বের কাছে। আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে। ১৯১৯ সালের ১৩ ই এপ্রিল। দিনটা শিখদের কাছে পবিত্র দিন। এই দিন তাদের বৈশাখী উৎসব, নতুন বছরের শুরু। কিন্তু সেই বছর পরিস্থিতি ভিন্ন।


 সারা পাঞ্জাব ফুটছিল টগবগ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজ ভারতকে স্বায়ত্বশাসন দিলই না, উপরন্তু ভারতের ওপর চাপলো কঠোর দমনমূলক এক আইন।তার নাম রাওলাট আইন।এই কালা আইনে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার,বিচার ছাড়াই বন্দী করার, উকিল ছাড়া বিচার করার মতো অমানবিক নীতির প্রচলন হলো।সারা বিশ্বের ইতিহাসে এমন দমনমূলক আইন বিরল।


 বর্বর এই আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি শুরু করলেন রাওলাট সত্যাগ্রহ। ৬ ই এপ্রিল দেশজুড়ে পালিত হলো প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট। পুলিশ গান্ধীজি কে গ্রেপ্তার করলেও জনগণের চাপে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। পাঞ্জাবে ও ছড়ালো আন্দোলনের ঢেউ। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হলেন দুই জনপ্রিয় নেতা, সত্যপাল ও সাইফুদ্দিন কিচলু। দুই নেতার গ্রেপ্তারিতে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন অমৃতসরের মানুষেরা। মুক্তির দাবীতে শুরু হোল বিক্ষোভ, মিছিল। ১৩ই এপ্রিল বিকেলে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘেরা মাঠে ডাকা হোল এক সভা। বৈশাখী উৎসবের সঙ্গেই হবে রাওলাট আইনের প্রতিবাদ। সভার পক্ষে চলল জোর প্রচার। এদিকে পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর তখন মাইকেল ও ডায়ার। পাঞ্জাব ছিল বিপ্লববাদের অনুসারী। বিদ্রোহের আগুন তাদের রক্তে। তাই দুর্দমনীয় পাঞ্জাবীদের দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার গভর্নর হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন নিষ্ঠুর এই অফিসারকে। ডায়ার তাঁর দায়িত্ব পালনে অবিচল। তাঁর কঠোর দমননীতি দ্বারা তিনি স্তব্ধ করতে চান সব প্রতিবাদ। এখানেও তিনি জারি করলেন দমনমূলক সামরিক আইন।সমস্ত মিটিং মিছিল সভা নিষিদ্ধ হোল অমৃতসরে। মাইকিং করে প্রচার করে দেওয়া হোল তা।



১৩ই এপ্রিল দুপুর থেকেই অমৃতসরের জনতা জালিয়ানওয়ালাবাগ মুখী। কাতারে কাতারে জনগন জমা হচ্ছে মাঠে। নারী শিশু বৃদ্ধরা আসছেন উৎসবে যোগ দিতে।আবার অনেকে আসছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তবে সামরিক আইনের কথা ভেবে নেতারা বলে দিয়েছেন জমায়েত হবে শান্তিপূর্ণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। কানায় কানায় পূর্ণ মাঠে শুরু হোল সভা। রাওলাটের কালা কানুন বাতিল করতে হবে, সত্যপাল ও কিচলুকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।এমন সময় সেই ঘেরা মাঠের একমাত্র প্রবেশপথ আটকে দাঁড়ালেন জেনারেল ডায়ার। সঙ্গে ৫০ জন গোর্খা ও বালুচ সৈন্য। হাতে তাদের এনফিল্ড রাইফেল। শ্লোগান থমকে গেলো এই রণসজ্জা দেখে। উৎসবের কলরব স্তব্ধ হোল। তখনই নীরবতা ভেঙে ঘোষণা হোল, ফায়ার। একসঙ্গে গর্জে উঠলো ৫০ টি রাইফেল। সোজাসুজি ভিড় লক্ষ্য করে। কিছু বোঝার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বহু মানুষ।আবার গর্জন, আবার বুলেট ফুঁড়ে দিলো একঝাক নিরীহ মানুষের বুক। চলতেই লাগলো ফায়ারিং। উৎসবের প্রাঙ্গন তখন আর্তনাদ, হাহাকার, সন্ত্রস্ত মানুষের আকুতি, নারী ও শিশুদের কান্নায়  ভরে উঠেছে। হাজারের বেশী মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে রক্তাক্ত দেহে। নিস্পন্দ প্রানহীন দেহের ওপর দিয়েই পাগলের মতো ছুটছে মানুষ। কিন্তু পালাবে কোথায়? গেট আটকে রেখেছে রক্তপিপাসু নররাক্ষসের দল।১০০র বেশি মানুষ ঝাঁপ দিলো মাঠের মাঝখানের কুয়োর ভেতর।সলিল সমাধি হোল তাদের। টানা ১৬০০ রাউন্ড ফায়ারিং এর পর থামল সেই হত্যালিলা। মাঠ জুড়ে তখন হাহাকার, কান্না, আর কাতর আর্তনাদ। মাটি ভিজে গেছে রক্তস্রোতে।রক্তাক্ত পরিজনের দেহ আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে মানুষ। মায়ের কোলেই নিথর হয়ে গেছে শিশু। আহতরা কাতরাচ্ছে মাটিতে পড়ে। এরপর সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হল দেহ লোপাট করার। তারা নির্মম ভাবে নিহতদের দেহ ছিনিয়ে নিয়ে টেনে হিঁচড়ে ফেলতে লাগলো মাঠের মাঝখানের বড়ো কুয়ায়।বহু দেহ লোপাটের পরেও মাঠে পড়ে রইলো ৩৭৯ টি দেহ। আহত হয়ে পড়ে রইলো ১২০০র বেশি মানুষ। মাঠ ঘিরে রাখল সেনারা। সন্ধ্যে গড়িয়ে গেলো। আহতদের চিকিৎসা করা দূরে থাক। একটু জল পর্যন্ত দেবার সাহস পেলনা কেউ। বাতাস ভারী হয়ে রইলো বারুদের গন্ধ, আর আর্তনাদের কাতর শব্দে। পেরিয়ে গেলো ১০০ বছর। আজ আবার সেই ১৩ই এপ্রিল। ১৯১৯ থেকে ২০১৯। আজও এই দিনটা এলেই অভিশপ্ত সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় দেশকে। অশ্রুজলে স্মরন করি,মুক্তির মন্দিরও সপানোতলে বলি হওয়া সেই প্রাণগুলিকে। ধিক্কার জানাই নিষ্ঠুর সেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে। জালিয়ানওয়ালাবাগ থাক শ্রদ্ধায় স্মরনে, ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায় হয়ে। শহীদ তোমাদের ভুলবো না কখনো, কোনদিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *