|বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামের দুঃস্থ পড়ুয়াদের দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে পাঠদান|
1 min read|বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামের দুঃস্থ পড়ুয়াদের দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে পাঠদান|
প্রবাল সাহা রায়গঞ্জ রায়গঞ্জ, ২৭ জুলাই : শিক্ষার আলো জ্বলে উঠুক ঘরে ঘরে, অর্থ যেন শিক্ষার পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় এই কথা গুলোকে আপ্ত বাক্য করে নিরলস ভাবে দীর্ঘ ১৭বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়া দের পাঠ দান করিয়ে চলেছেন রায়গঞ্জের রায়পুর অঞ্চলের বাসিন্দা প্রফুল্ল সেন। বর্তমানে বয়স ৮৫ বছর। স্নাতক পাশের আগেই চাকরি পান কেন্দ্রীয় সরকারের বর্ডার সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন দপ্তরে অফিস সুরারেনটেন্ট পদে। চাকরি জীবনে দেশ সুরক্ষার কাজে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। তাই নিজের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা সুযোগ হয়ে ওঠেনি।তাই অবসর নেওয়ার পর সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি।
এই বয়সেও থেমে নেই প্রফুল্লবাবু ।ইচ্ছে থাকলেও কর্মজীবনে গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করতে পারেননি। তাই এখন প্রতিদিন দুইবেলা নিয়ম করে গ্রামের দুঃস্থ ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি পাঠদান করেন। এই শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন পড়ুয়াকে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান করছেন তিনি । রায়পুর গ্রামের যে সমস্ত দুঃস্থ পড়ুয়ার বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা তাদের শুধু পাঠদান করেন না তিনি সেইসঙ্গে তাদের হাতে নিয়মিত বই,খাতা,কলম তুলে দেন।আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ শ্রমিক এবং দিন মজুরের কাজে যুক্ত। করোনা আবহে শ্রমিকদের কাজ কমে গিয়েছে। অনেকে আবার ভিনরাজ্য থেকে বাড়িতে ফিরে কাজ না পেয়ে বেকার হয়ে বাড়িতে বসে রয়েছেন। তাই একদিকে যেমন পেট চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে, অপরদিকে ইচ্ছে থাকলেও ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করাতে পারছেন না।করোনার কারনে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকায় পড়ুয়ারা লেখাপড়া থেকে অনেকটা দূরে গেছে।গ্রামের ছেলেমেয়েরা যাতে পড়াশোনার জগৎ থেকে সরে না যায় সেজন্য তাদের লেখাপড়ার দায়িত্বভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন প্রফুল্লবাবু ।
গ্রামের কচিকাঁচারা যাতে লেখাপড়া থেকে দূরে সরে না যায়, সেদিকে নজর দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান তিনি। প্রফুল্লবাবুর যৌবনকালে ইচ্ছে ছিল উচ্চ শিক্ষিত হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করবেন।কিন্তু পারিবারিক আর্থিক দূরাবস্থার কারনে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি।পরবর্তীতে চাকরি ক্ষেত্রে পদোন্নতি ঘটে তাঁর। এরপর দীর্ঘ কর্মজীবন কাটিয়ে ২০০২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন গ্রামের শিক্ষা প্রসারের কাজে যুক্ত হবেন।সেভাবে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করেন।বাড়ির পাশেই রায়গঞ্জ ভারত সেবাশ্রম সংঘের মাধ্যমে গড়ে তোলেন বাচ্চাদের একটি স্কুল।গ্রামগঞ্জের প্রায় ২০০ পড়ুয়া সেখানে পড়াশোনা করে।সেখান থেকেও কোনো পারিশ্রমিক নেন না।২০০৬ সাল থেকে তিনি গ্রামের দুঃস্থ পড়ুয়াদের বিনা পারিশ্রমিকে ইংরেজি পড়াতে শুরু করেন।প্রথমে নবম ও দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের নিয়ে নিজের পাঠভবনে পাঠদান শুরু করলেও পরবর্তীতে গ্রামের দিন আনা দিন খাওয়া পরবিবারগুলোর ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়াতে শুরু করেন। বর্তমানে প্রায় ৩০ জন ছেলে – মেয়ে দুইবেলা ইংরেজি পাঠ নেয়।প্রফুল্লবাবুর স্ত্রী মঞ্জু সেন স্বামীর এই কাজকে সবসময় খুব উৎসাহ দেন।প্রফুল্লবাবু ও মঞ্জুদেবীর তিন ছেলে- মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে ছত্রিশগড়ে এবং দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে হয়েছে দিল্লিতে।ছোটো ছেলে দেবব্রত দিল্লিতে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ডেপুটি ম্যানেজার এবং সেখানকার একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন বৌমা অনিন্দিতা।গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবে রায়গঞ্জের রায়পুর গ্রামের বাড়িতে প্রফুল্লবাবু ও মঞ্জুদেবী দুইজন থাকেন।প্রফুল্লবাবু বলেন,শিক্ষকতা করার খুব ইচ্ছে ছিল,কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি।তাই অবসরের পর শিক্ষকতা করার জন্য নিজেকে তৈরি করে ফেলি।গ্রামের ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি শেখানোর ২০০৬ সাল থেকে নিজের বাড়িতে পাঠভবন গড়ে তুলি।সেই সময় থেকে গ্রামের দুঃস্থ ছেলে-মেয়েদের সহজ – সরল ভাষায় ইংরেজি পাঠদান দিচ্ছি।প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ জন পড়ুয়া মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। এবছর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পাঠদান দেওয়া শুরু করেছি।তিনি বলেন,গ্রামের দুঃস্থ ছেলে-মেয়েরা শিক্ষক নিতে পারে না।আবার তারা ইংরেজি বিষয়কে ভয় পায়।সেই কারনে আমার এই চেষ্টা।
বরুয়া অঞ্চলের সোনাডাঙ্গি,কানাইপুর,রায়পুর এবং কাশিবাটি গ্রামের দুঃস্থ ছেলে-মেয়েদের ভরসা গ্রামের প্রফুল্ল স্যার।মনীষা তালুকদার, অঙ্কিত সেন,নীতিকা দেবনাথ,রুদ্র বর্মণের মতো আরো অনেকে স্যারের কাছে অনেক দিন ধরেই টিউশন পড়েন।এদের কারো বাবা দোকানের কর্মচারী,কারো বাবা টোটো চালায়।আবার কেউ কেউ কৃষি কাজ করেন। প্রফুল্লবাবু বলেন, গ্রামের দুঃস্থ ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে না পেরে খেলাধুলোয় মেতে থাকে। লেখাপড়া ভুলে যাচ্ছে। অর্থের অভাবে অনেকেই তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়াতে পারছেন না। গ্রামের শিশুরা যাতে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত না হয়,সেজন্য যতদিন পারব গ্রামের পড়ুয়াদের এই ভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে যাব।প্রফুল্লবাবু বলেন,বয়স ৮৫ হলেও আমার কোনো ক্লান্তি নেই।শিক্ষাদানে আরও শিক্ষালাভ করা যায় এবং পড়ুয়াদের মাঝে পাওয়া যায় অপার আনন্দ।যা পেনশন পাই তা দিয়ে ভালো মতো দিন কেটে যায়। গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা আমার প্রাণ।গ্রামের বাসিন্দা প্রনব দেবনাথ বলেন,তাঁর মতো মানুষ বর্তমান সমাজ বিশেষত যুবদের কাছে প্রেরণা। উনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রামের দুঃস্থ ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করে থাকেন।পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা জানান,প্রফুল্লবাবু একজন নিষ্ঠাবান ও সেবাপরায়ণ শিক্ষক।উনি না থাকলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেত। গত ১৭ বছরে প্রফুল্লবাবুর বহু প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষিত হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।সকলের ভালোবাসায় গ্রাম ছাড়তে পারেননি তিনি,ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সারা বছর মেতে থাকেন।