October 26, 2024

এটাই কি গণতন্ত্রে কাম্য ছিল ?

1 min read

      
তন্ময় চক্রবত্তী ঃ-
২০ হাজার ৭৬ জন প্রার্থী
জয়ীহলেন
ভোটারদের মুখোমুখি না-হয়েই
প্রথমে দেখা গেল ভোট অনুষ্ঠানের আগেই একের পর এক আসন জিতেনিল
শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। ৩৪ শতাংশ আসনে ভোট দেওয়ারই সুযোগ পেলেন না নাগরিকরা। ।
সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নাগরিকদের বস্তুত শাসক দলের চাপিয়ে দেওয়া একদল মানুষের
মর্জিমতোই চলতে হবে আগামী পাঁচ বছর। উল্লেখ করার মতো ঘটনা হল
, রাজ্যের
২০টি জেলার মধ্যে মাত্র আটটিতে সব আসনে ভোট ছিল সোমবার। অন্যদিকে
, এদিন
এক জায়গায় দেখা গেল
, ভোটগ্রহণ
আরম্ভ হওয়ার সামান্য পরেই বাক্স ভেঙে শুরু হয়ে গেল
ভোট গণনার কাজ! অথচ গণনার দিন নির্দিষ্ট রয়েছে আগামী ১৭
তারিখ। সেইদিন অবধিও হয়তো সবুর সইছে না কারও কারও। এ কী অস্থিরতা!
 


২০১৩ সালে শাসক দলের লড়াই ছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে তাদের
কাছে মাথা নোয়ানোর জন্য। আর এবার বিরোধীরা লড়লেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে তার
সাংবিধানিক দায়িত্বপালনে বাধ্য করার লক্ষ্যে। গণতন্ত্রের অনেক আবর্জনা হাইকোর্ট
, সুপ্রিম
কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। তবু শেষরক্ষা হল কি
? প্রশ্নটি আমাদের ভাবাচ্ছে।
সোমবার নির্দিষ্ট ছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থার তিন স্তরের মোট ৬৬
শতাংশ আসনের ভোট। ৪৬৬৮৫টি বুথে। সেও ছিল মন্দের ভালো। কিন্তু সেটুকুও সুষ্ঠুভাবে
করা গেল বলে তৃণমূলের শান্তিপ্রিয় একজন সমর্থকও ভাবছেন না। সোমবার ভোট চলাকালে
অনেকজনের প্রাণ গেল! আর এই ভোটের আগেই খুন হয়েছেন ১৪ জন রাজনৈতিক কর্মী। বহু মানুষ
আহত হয়েছেন। বহু সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর চলেছে খিস্তি খেউড়ের বন্যা এবং
মানীর মানহানি বাধাহীনভাবে। ভাবতেও শিউরে উঠি আমরা!
 


পঞ্চায়েত ভোট মানে অর্ধেক বাংলার ভোট। গ্রামবাংলার ৫ কোটি
৮৩ লক্ষ নরনারী ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কথাটি এইজন্য বলা যে
, দেশের
অন্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলার মানুষ অনেক বেশি রাজনীতি-সচেতন। এখানকার বেশিরভাগ
মানুষ ভোট দিতে ভালবাসেন। রোদে জলে কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াতে প্রস্তুত থাকেন। এমন
একটি দিন রুটি রুজির সঙ্গে আপস করতেও কুণ্ঠিত হন না। কিন্তু বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার
নষ্টামির কাছে হার হল তাঁদের বিপুল প্রত্যাশার।


২০১৩ সালে ভোট হয়েছিল পাঁচ দফায়। সেবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর
৮২ হাজার ‌জওয়ান মোতায়েন করা হয়েছিল। তার পরিবর্তে এবার দায়িত্ব পেল ৮০ হাজার
সিভিক ভলান্টিার। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধীদের
প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। রাজ্য সরকার যে-দলের পঞ্চায়েত-জেলাপরিষদও সেই দলের হলে
নাকি উন্নয়নের কাজ বেশি করা সম্ভব! এমন এক সর্বগ্রাসী অজুহাত খাড়া করে এক মন্ত্রী
বিরোধী-শূন্য প্রতিটি পঞ্চায়েতকে ৫ কোটি টাকা দেওয়ার কথা আগাম ঘোষণা করেন।
মনোনয়নপত্র পেশ
, প্রচার
থেকে কমিশনের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শিথিলতা কি সেই
উদ্দেশ্যপূরণের জন্য ছিল না
? এই প্রশ্ন তোলার অবকাশ রুখতে হলে এবারও একাধিক দফায় ভোট
নেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হতো। পর্যাপ্ত পরিমাণে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার
উদারতাও কাম্য ছিল।


উন্নয়নতো আর নমিনেশন জমা দেওয়া পর্যন্ত সক্রিয় থেকেই ক্ষান্ত হল
না। ভোট গ্রহণের দিনেও দিকে দিকে তার দবদবা দেখাল!

অথচ সকলের অনুমান ছিলভোটটা ঠিকঠাক হলে তৃণমূল একাই বেশিরভাগ আসনে জিতত।
কিছু আসন পেত বিরোধীরা। যেটা খুব দরকার ছিল। পঞ্চায়েত প্রশাসনের স্বচ্ছতার
স্বার্থে। যে-কাজটি বিরোধীরা করত
, সেটা কি তৃণমূলের মধ্যে থেকেই চায় সরকারি দল? ভুলে
গেলে চলবে না
, এই যে
সংস্কৃতি লালিত পালিত হচ্ছে তাতে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই বাড়তে থাকবে। শাসক
এবং বিরোধী পক্ষের নীতির লড়াইয়ের মধ্যে যে সুস্থতা থাকা সম্ভব ছিল
এই
পরিস্থিতি সেটাই হারাবে। সব সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ প্রধানের কাছে রাজ্য
নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট তলবের অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক আগেই হারিয়েছে। বাংলা এই
তঞ্চকতা দেখছে কম করে সিদ্ধার্থ-জমানা থেকে।

ভোট করানোর কনসেপ্ট থেকে যতদিন না বেরিয়ে আসা যাবে ততদিন ভোটের
স্বচ্ছতা নিরপেক্ষা বলে কিছু আশা নেই।
ভোট করানোকথাটির মধ্যেই রয়ে যায় পেশিশক্তির প্রচ্ছন্নতা। ভালো
প্রার্থীরা দাঁড়াবেন। তাঁদের হয়ে অবাধ প্রচার চলবে। পাঁচ বছরের শাসনের সুফল কুফল
দেখে জনমত তৈরি হয়ে থাকবে। ভোটের দিন মানুষ নিরপেক্ষভাবে তাঁদের মতামত দেবেন বুথে
গিয়ে। গণনার দিন থাকবে শুধু অপার কৌতূহল
, বাহুবল নয়। তার পর যাঁরা জিতবেন তাঁদের নিয়ে তৈরি হবে
সরকার কিংবা লোকাল গভর্নমেন্ট। গোরু গাধার কায়দায় জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার নোংরামিও
ভুলে যেতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থা যতদিন না এই চেহারা পাবে ততদিন
গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার
কথাটি উচ্চারণ করা পাপ। সেই উচ্চতায় যতদিন না পৌঁছাব তার আগে
আমরা
উন্নত
বলে
দাবি করলে গণতন্ত্রের দেবতা কাঁদবেন অথবা তির্যক দৃষ্টি হেনে হাসতে থাকবেন।

১৯৭৭ সালের জুনে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গড়েন জ্যোতি বসু।
মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশা কাঁধে নিয়ে। ১৯৭৭ সালের ২৫ আগস্ট বিধানসভায় বাংলার নতুন
নায়ক জ্যোতিবাবুকে সাক্ষী রেখে অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র প্রথম বাজেট ভাষণে লেনিনকে
উদ্ধৃত করে বলেছিলেন
, ‘‘অর্থনীতি
আসলে হচ্ছে পরিস্রুত রাজনীতি।
’’ বাংলাকে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত পরিস্রুত রাজনীতি উপহার দেওয়ারই
অঙ্গীকার শোনা গিয়েছিল জ্যোতি বসুর কণ্ঠে। অথচ পরিতাপের সঙ্গে আমরা দেখেছি
, মিত্র
মহাশয়ের প্রত্যাশা পূরণের বদলে টানা ৩৪ বছরে জ্যোতিবাবুর দল সিপিএম কোন রাজনৈতিক
সংস্কৃতি আমদানি করে গিয়েছে। মানুষের প্রত্যাশার বেশিরভাগটাই জ্যোতি বসু কাঁধ থেকে
পথের ধুলোয় নামিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র এক দশকেই।

তাই একটি পরিবর্তন’-এর প্রত্যাশায় রাজ্যবাসী পাগল হয়ে ছিল বহুকাল। ২০১১ সালে
আমরা পেলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরিবর্তন-এর কান্ডারি
, নতুন
অবতারকে। সেই বছর ২ জুন রাইটার্স থেকে তাঁর সই এবং ছবিসহ একটি আবেদনপত্র প্রকাশ
করা হল
—‘পশ্চিমবঙ্গ
সরকারের সহকর্মীদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন
শিরোনামে ওই পত্রে মমতা দেবী বললেন, ‘‘আমাদের
একজোট হয়ে এবং নতুন উদ্যমে পশ্চিম বাংলার কাজকর্মের আরও বেশি উন্নয়ন আনতে হবে। …
আপনারাই পারেন বাংলার গৌরবকে সসম্মানে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে। আসুন আমরা
সবাই মিলে পশ্চিম বাংলার উন্নয়নে একসাথে কাজ করি। … পশ্চিম বাংলার ভাবমূর্তি
উন্নততর করার করার কাজে ব্রতী হই।
’’
মমতা দেবীর এই মূর্তিকেই সেদিন দল মত নির্বিশেষে প্রায়
সমস্ত মানুষ তাদের বিশ্বাসের বেদিতে স্থাপন করেছিল। কারণ তার মধ্যে ছিল
যত মত
তত পথ
’-এর
প্রতি শ্রদ্ধা। ক্ষমতার মধুভাণ্ডের জন্য লালসা নয় গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা। মানুষের
প্রতি অপার ভালোবাসা। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সোমবার পর্যন্ত যে ছবি বাংলাকে
দেখানো হল সেখানে মমতা দেবীর প্রথম সরকারি আবেদনের মর্যাদা কতটুকু অক্ষুণ্ণ রইল তা
তাঁকেই ভেবে দেখতে হবে। এই ঘটনায় গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হল তা অপরিমেয় নিঃসন্দেহে।
তৃণমূল দল এবং সর্বোপরি অনেকের একদা প্রাণাধিক প্রিয়
দিদি
অমর্যাদাও কি কম হল
? এই
ক্ষতি কি সহজে পূরণ হবার
? জানা
নেই।

0 thoughts on “এটাই কি গণতন্ত্রে কাম্য ছিল ?

  1. পশ্চিবঙ্গের মানুষ রাজনীতি সচেতন বলে একটা ঢক্কানিনাদ ইংরেজ আমল থেকে চলে আসছে।সেসময় হয়ত সত্যিই তাই ছিল।কিন্তু বাম আমলে এই কথাটা ব্যাবহার করে বাঙ্গালীর জাত্যাভিমানে সুড়সুড়ি দিয়ে নির্বিঘ্নে রাজত্ব করে গেছে জ্যোতিবাবুর দল।অধুনা কিছু নবীন সাংবাদিক প্রেক্ষাপট না বুঝে ব্যাবহার করছে।অথবা শাসকদলের অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য এটা করছে।
    একটা ছোট উদাহরন দিলেই বোঝা যাবে বাঙ্গালী কত রাজনীতি সচেতন ছিল।পশ্চিমবঙ্গ এবং উড়িষ্যায় একই সঙ্গে জমি উর্ধসীমা আইন পাশ হয়।সময়টা বিধান চন্দ্র রায়ের আমল।উড়িষ্যায় উর্ধসীমার মাপকাঠি হয়,জমির উৎপাদনশীলতার নিরিখে,কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা কিন্তু হয়নি।ফলে দুফসলী তিনফসলী জমির সাথে একফসলী বা পতিতজমি একইপংতিতে স্থান পায়।এতে উড়িষ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের জমি মালিকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।বাম আমলে বিনয় কোঙার এবিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরির্তনের চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন।আরো অনেক উদহরন আছে যাতে করে বলা যায়,বাঙ্গালী সচেতন সব বিষয়ে এটা আদপেই ঠিক নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *