October 27, 2024

বিশ্বকাপের থেকেও বিশ্ব-টা অনেক অনেক বড়

1 min read
১৯৩৮ সাল । ফেব্রুয়ারি মাস । অফিসিয়ালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি । হিটলারের জার্মানি দখল করে নিলো প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রিয়া । সেই সময় অস্ট্রিয়ান ফুটবল দল সারা পৃথিবীতে “ওয়ান্ডার টিম” নামে খ্যাত ছিল তাদের শৈল্পিক ফুটবল আর অপরাজেয় মানসিকতার জন্য । আর তাদের দলনায়ক ওই সময়কার বিশ্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার ‘Mozart of Football’ ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার । দুর্ধর্ষ ড্রিবলার, দুপায়েই দারুণ শট, সৃজনশীল সেন্টার ফরোয়ার্ড ।আর সাথে সাথে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ।ওই বছরের ৩ রা এপ্রিল জার্মানি আর তাদের অধিকারে থাকা অষ্ট্রিয়ার মধ্যে ফুটবল ম্যাচ ।নাৎসি বাহিনীর পরিস্কার নির্দেশ, ম্যাচ ড্র রাখতে হবে । জার্মানিকে হারানো যাবে না ।
 কিন্তু দলনায়ক সিন্ডেলার তা মানতে নারাজ । তার ইচ্ছানুযায়ী চিরাচরিত সাদা কালো রঙের বদলে অস্ট্রিয়ান জাতীয় পতাকার রং এর লাল-সাদা-লাল জার্সি পরে ম্যাচ খেলতে নামল অস্ট্রিয়া । প্রথমার্ধ গোলশূণ্য রইল । কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে টিম ম্যানেজমেন্ট এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজে দলকে অনুপ্রাণিতই শুধু করলেন না, প্রথমে একটা গোল করে নাৎসি অফিসারদের সামনে আনন্দ করলেন । তারপর সহখেলোয়াড় সেস্তাকে দিয়ে আরেকটা গোল করালেন । ম্যাচের স্কোর
পরাধীন অস্ট্রিয়া ২ – হিটলারের জার্মানি ০।বিষয়টা ভালোভাবে নেননি স্বয়ং ফুহেরার । এর পরেও সেই বছরেই বিশ্বকাপ ফুটবলে তাদের বলা হলো, জার্মানির হয়ে খেলতে । কিন্তু না, শুধু সেই বিশ্বকাপ নয়, কোনওদিন সিন্ডেলার জার্মানির হয়ে নামেন নি ।বলেছিলেন জোর গলায়, “কোনদিনও খেলবো না, তবুও ওদের হয়ে খেলতে নামবো না ।” ফলে স্বাভাবিকভাবেই যা হবার তাই হলো, ১৯৩৯ সালের ২৩ শে জানুয়ারি এই মহান শিল্পী ফুটবলার আর তার প্রেমিকাকে ঘুমের মধ্যে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে হত্যা করলো নাৎসিরা । সিন্ডেলার মারা গেলেও বেচে থাকল তার ল্যেগাসি ।ফুটবল বিপ্লবীর ল্যেগাসি । যেই ল্যেগাসি অনেক পরে বহন করবার দায়িত্ব নিলেন আর একজন চিরশ্রেষ্ঠ ।যোহান ক্রুয়েফ । ওই সময়ের দুর্ধর্ষ নেদারল্যান্ড দলের প্রাণভোমরা । ১৯৭৪ বিশ্বকাপের গোল্ডেনবল জয়ী । ১৯৭৮ সাল । বিশ্বকাপের আসর বসেছে আর্জেন্টিনায় । সে দেশে তখন সেনা শাসন । গণতন্ত্র হত্যা হচ্ছে প্রতিদিন ।প্রেস মিট ডেকে সেই ক্রুয়েফ ঘোষণা করলেন, “যে দেশে মানুষের কোনো মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত নয়, যেখানে গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে, সেখানে আমি বিশ্বকাপ খেলতে যাব না ।”হ্যাঁ, যাননি ক্রুয়েফ । শত অনুরোধেও যাননি । মানবাধিকারের জায়গাটা সবচেয়ে ওপরে,বুঝিয়েছিলেন তিনি ।নেদারল্যান্ড দ্বিতীয় বারের জন্য রানার্স হয় সেইবার।ব্যাটনটা এবার বিশ্বফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনার হাতে । ১৯৮৬, মেক্সিকোতে বসেছে বিশ্বকাপের আসর । পিটার শিল্টন, ব্রায়ান রবসন, গ্যারি লিনেকারদের ইংল্যান্ড এর সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল । সেই ইংল্যান্ড, যারা গায়ের জোরে দখল রেখেছে ফকল্যান্ড দ্বীপ । যারা প্রতিদিন সেখানে মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে ।খেলা শুরু হবে, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়ে গেছে, এইরকম সময়ে দলনায়ক মারাদোনা বলে উঠলেন, “ওই দেখো ইংল্যান্ড দল দারিয়ে আছে, জানি ওই প্লেয়ারগুলোর কোনো দোষ নেই, কিন্তু ওরা যে রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করছে তারা আমাদের দেশের অংশ দখল করে রেখেছে, ফকল্যান্ড এর ছোটোছোটো বাচ্চাগুলোকে হত্যা করেছে । আজ ওদের হারাতেই হবে, দেশের জন্য ।”
আর তারপরেই সেই, “Hand of God” আর “Goal of the century”। সেই এক ম্যাচেই।
এর অনেক পরে তিনি ফিদেল কাস্ট্রোর পাশে, উগো চাভেজের সাথে । সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যেকোনো লড়াইতে অংশীদার ।
জোর গলায় বলছেন, “I think Bush is a murderer. I am going to head the march against him stepping foot on Argentine soil.
…I believe in (Hugo) Chavez, I am Chavista. Everything Fidel (Castro) does, everything Chavez does, for me is the best.”
সেই শক্তিশালীর সামনে শিরদাঁড়া না বাঁকানোর ঐতিহ্য । সেই ল্যেগাসি ।১৯৮৮ সাল । ইউরো কাপ জিতেছে নেদারল্যান্ড । দলনায়ক, সে বছরের ব্যালন দি অঁর “Black Tulip” রুদ গুলিত।সেই ঝাঁকরা বিনুনি করা চুলের মালিক গুলিত । সারা মাঠ জুড়ে অসম্ভব পরিশ্রম করে খেলা গুলিত । দেশে ফিরেই ঘোষণা করে দিলেন প্রাইজমানি বাবদ প্রাপ্ত সব অর্থ তিনি বিশ্বজুড়ে কালো মানুষের মুক্তির সংগ্রামে দিয়ে দিচ্ছেন । এবং তিনি তা করেওছিলেন ।২০১৪ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ান টীমের তুর্কি বংশজাত জার্মান প্লেয়ার মেটুস ওজিল তার প্রতিযোগিতার সমস্ত পুরস্কার মূল্য প্যালেস্টাইন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত মানুষদের জন্য দান করে দেন ৷ফুটবলের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে । পাবো কি আমরা এরকম আর কোনো মহানায়ককে ? যে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বেশী করে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবমুক্তির চেতনাটাকে জয়ী করতে চাইবে ?নাকি ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি ?কোনো এক লিওনেল মেসির মধ্যে ?গত কয়েকদিন আগে, সব দলগুলোই যখন প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে বেড়াচ্ছে, সারা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন আর্জেন্টিনা বনাম ইজরায়েল ম্যাচ নিয়ে ।সেই ইজরায়েল যারা লক্ষ লক্ষ শিশু হত্যার দায়ে অভিযুক্ত, সেই ইজরায়েল যারা প্যালেস্টাইন এর ওপর অনৈতিক দখলদারি চালিয়ে যাচ্ছে,মানবাধিকার যাদের কাছে একটা শব্দ ছাড়া কিছু নয়, তাদের সাথে খেলা । এইরকম একটা টুর্নামেন্টের আগে প্রস্তুতি ম্যাচ গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম । কিন্তু ল্যেগাসিটা তো কাউকে বহন করতেই হতো ।মেসি শুধু এই ম্যাচ খেলবেন না, এই সিদ্ধান্তই নিলেন না, নিজের দলের বাকী খেলোয়াড়দেরও না খেলার জন্য রাজী করালেন । তারপর কোচ আর সব শেষে নিজের দেশের ফুটবল অ্যসোসিয়েশনকেও রাজী করিয়ে এই ম্যাচ বাতিল করাতে বাধ্য করলেন । আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যসোসিয়েশন ১৪ লক্ষ আমেরিকান ডলার ক্ষতি করে, স্পন্সরদের চাপ উপেক্ষা করে ফিফার থেকে ব্যান হবার ভয়কেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মানবতার পাশে দাড়ালো । সৌজন্যে লিওনেল মেসি ।নেপথ্যের নায়ক লিওনেল মেসি।তিনি এক সাক্ষাৎকারে TYC sport কে বলেছেন,”As a UNICEF ambassador I cannot play against people, who kill innocent palastinian children. We had to cancel the game because we are humans before footballers”।হ্যাঁ, “Humans before footballers”।মেসি, মারাদোনা,ক্রুয়েফ,গুলিত, সিন্ডেলার-রা তাই,,,, আগে মানুষ । বিশ্বকাপ সবাই জেতেনা । মারাদোনা একবার এই স্বাদ পেলেও ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার জেতেননি, ক্রুয়েফ জেতেননি, গুলিত জেতেননি ।কিন্তু এরা সবাই বিশ্ববাসীর হৃদয় জিতেছেন । যেরকম জিতেছেন মেসি । তার খেলা দিয়ে, তার সিদ্ধান্ত দিয়ে । বিশ্বকাপ এবারে মেসির আর্জেন্টিনা জিতবে না অন্য কোনো দেশ সেটা পরে জানা যাবে । কিন্তু মেসি যে ইতিমধ্যেই “বিশ্ব”জয় করেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যেতেই পারে, বিশ্বকাপের থেকেও বিশ্ব টা অনেক
অনেক বড় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *