October 27, 2024

উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে আত্মঘাতীর সংখ্যা

1 min read

এই ভারতবর্ষে যে সকল গুরুতর সমস্যা সামাজিক ভাবে রয়েছে তার অন্যতম সমস্যা আত্মহত্যা। এ সমস্যা শুধু যে সামাজিক তা নয়, অর্থনৈতিক কখনও কখনও রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবেও দেখা দেয়। সারা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনায় ভারতবর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রতি এক লাখে ১০.৫জন আত্মহত্যা করেন। সারা বিশ্বের এই হিসেব প্রতি লাখে ১১.৬জন প্রতি বছরে সারা বিশ্বে ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যার শিকার হন। এই পরিসংখ্যানে ভারতবর্ষে প্রতি বছর ১,৩৫,০০০ (১৭%) আত্মহত্যা করেন। পৃথিবীতে এই আত্মহত্যা ১৭.৫%। ২০১২ সালে ভারতবর্ষে এই আত্মহত্যা দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে ৭.৯ থেকে ১০.৩জন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে। তামিলনাডুতে ১২.৫%, মহারাষ্ট্রে ১১.৯% এবং পশ্চিমবাংলায় ১১% মানুষ আত্মহত্যা করেন। পুরুষ ও নারীর আত্মহত্যার অনুপাত ২:১। ২০১০ সালে একটি তথ্য জানায় আত্মহত্যার সংখ্যা ভারতে ১,৮৭,০০০ যেখানে সরকারি তথ্য জানাচ্ছে আত্মহত্যার পরিমাণ ১,৩৪,৬০০। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী ভারতে প্রতি লাখে নারীদের আত্মহত্যা ১৬.৪ যা পৃথিবীতে ষষ্ঠ এবং পুরুষদের আত্মহত্যার ঘটনা প্রতি লাখে ২৫.৮ যা পৃথিবীতে ২২তম।

ভারতবর্ষের সরকার আত্মহত্যাকে তিন ধরনে বিভক্ত করেছে


অস্বাভা‍‌বিক মৃত্যু  ব্যক্তি নিজের চেষ্টায় বা ইচ্ছায় আত্মহত্যা।  কোনো নির্দিষ্ট কারণের জন্য ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});



এই কারণের সাথে যেটি যুক্ত করা হয়নি যে অসুস্থতার কারণে আত্মহত্যা।

২০১৪ সালে ভারতবর্ষে আত্মহত্যার সংখ্যা ও কারণ —

 ঋণের দায়ে দেউলিয়া — ২,৩০৮

 বিবাহ সংক্রান্ত কারণে — ৬,৭৭৩

 বিবাহ অস্থায়ী কারণে — ১,০৯৬

 বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক — ৪৭৬

 বিবাহ বিচ্ছেদ — ৩৩৩

 অন্যান্য — ২,৬০৭

 পরীক্ষায় বিফল — ২,৪০৩

 বন্ধ্যাত্ব — ৩৩২

 পারিবারিক সমস্যা — ২৮,৬০২

 অসুস্থতা — ২৩,৭৪৬

 এইডস — ২৩৩

 ক্যানসার — ৫৮২

 প্যারালিসিস —৪৩৮

 মানসিক অসুস্থতা — ৭,১০৪

 দীর্ঘ রোগভোগ — ১৫,৪১৯

 নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু — ৯৮১

 ড্রাগ নেশা — ৩,৬৪৭

 সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ — ৪৯০

 আদর্শগত কারণে — ৫৬

 প্রেমজনিত — ৪,১৬৮

 দারিদ্র্য — ১,৬৯৯

 বেকারি — ১,০৬৭

দক্ষিণে কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাডু এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবাংলায় আত্মহত্যা সর্বাধিক এমনকি ত্রিপুরা, মিজোরামেও প্রতি এক লাখে ১৬। অন্যদিকে পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে আত্মহত্যার ঘটনা নিতান্ত কম অর্থাৎ লাখে চারজন। বিহার সর্বনিম্ন প্রতি ১ লাখে ০.৮।

বয়সের ধরন লক্ষ্য করলে দেখা যায় ২০১২-তে ৪৬,০০০জন আত্মহত্যা করেছেন তাদের বয়স ১৫-২৯ এবং ৩০-৪৪।

অবাক বিষয় হল এই আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের ৮০% শিক্ষিত। জাতীয় শিক্ষা মানের ৭৪%।

পু্রুষের আত্মহত্যার সংখ্যা নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। পশ্চিমবাংলায় নারী আত্মহত্যা করার ঘটনা সর্বাধিক — ৬,২৭৭, যদিও পুরুষ নারীর আত্মহত্যার অনুপাত ৪:৩।

মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল

সাধারণভাবে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মোট ব্যয়ের ৮০% নিজের এবং ২০% সরকারি পরিষেবা। সারা দেশে ৪% মানুষ দেখা যাবে যারা স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা খাতে ব্যয় করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এই চিত্র প্রতি বছরের। ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন মানুষ মানসিক রোগের শিকার হন। তাদের ৫০% অবসাদজনিত। মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় ভারতবর্ষে সেই বা‍‌জেটের ০.০৬% ব্যয় হয় মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মধ্যে।

ভারতবর্ষে প্রতি ১ মিলিয়ন মানসিক রোগীর জন্য মাত্র তিনজন সাইক্রিয়াটিস্ট আছে। সারা পৃথিবীতে এই সংখ্যা ৫৬। অবিলম্বে ভারতবর্ষে ৬৬,২০০ মনচিকিৎসকের প্রয়োজন।

সাধারণ স্বাস্থ্য পরিষেবা

ভারতবর্ষে স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিস্থিতি আলোচনা করতে হলে প্রথমে বলতে হয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যে সকল প্রয়োজন সর্বাধিক তা হল (১) শৌচাগার-এর সুব্যবস্থা (২) বর্জ্য পদার্থ অপসারণ (৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র যা হবে উন্নত এবং (৪) পেশাদারী স্বাস্থ্য পরিষেবা।

ভারতবর্ষে প্রতি ১ লাখ জনে ২৫৩জনের বিভিন্ন রোগে মৃত্যু হয়। পৃথিবীতে এই পরিসংখ্যান ১৭৮। প
ৃথিবীর অধিকাংশ দেশের তুলনায় ভারতবর্ষে রোগভোগ বেশি। ভারতবর্ষের এই করুণ পরিস্থিতির তুলনায় নেপাল কিংবা বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভাল।

এই চরম অসুস্থতার কারণে ভারতবর্ষের শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় এবং মজুরিও নিম্নমানের হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১০-এর তথ্যানুযায়ী ভারতবর্ষে জি‍‌ ডি পি ৬% কমে গেছে অকাল মৃত্যু এবং প্রতি‍রোধযোগ্য ব্যাধিতে।

সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা যা দরিদ্র মানুষেরা পায় তা অতি নগণ্য। তারা সরকারি পরিষেবা যথেষ্ট না পেয়ে এবং স্বাস্থ্য বিমা না থাকার দরুন বেসরকারি পরিষেবার কবলে পড়তে বাধ্য হয় এবং নিঃস্ব অবস্থায় গিয়ে পড়ে।

ভারতবর্ষে চিকিৎসা পর্যাপ্ত না হওয়ার একটা বড় কারণ অপর্যাপ্ত চিকিৎসক।

গত ২৪ আগস্ট, ২০১৬ ওড়িশায় জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীর অসুস্থতায় কাঁধে নিয়ে ১০ কিমি পথ হেঁটে চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছান। কোনো অ্যাম্বুলেন্স তাদের নিয়ে যায়নি।

গত ২৯ আগস্ট, ২০১৬ কানপুরে জনৈক ব্যক্তির কাঁ‍ধে তার পুত্র মারা যায় কোনো হাসপাতাল তাকে ভর্তি নেয়নি।

এই দুটি ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানা গেছে যেখানে সারা দেশে হাজার হাজার অসুস্থ রোগী এই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে ৫ লক্ষ চিকিৎসক প্রয়োজন। অন্ততপক্ষে প্রতি এক হাজারে একজন চিকিৎসক প্রয়োজন। ২০১৪ সালের শেষে ভারতবর্ষে মোট চিকিৎসকের সংখ্যা ৭,৪০,০০০ যেখানে চিকিৎসক ও রোগীর অনুপাত ১:১৬৭৪। এই তথ্য ৮ মার্চ ২০১৬ রাজ্যসভা এবং লোকসভার উভয়কক্ষেই উপস্থিত হয়েছে।

ভারতবর্ষে ৫৫,০০০ চিকিৎসকদের মধ্যে ৫৫% প্রতি বছর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে আসছে। বেআইনি অর্থ লেনদেনের মধ্যেও এই ব্যবস্থা চলছে। তামিলনাডু মেডিক্যাল কলেজে স্নাতক হওয়ার খরচ ২ কোটি। এই তথ্য ২৬ আগস্ট ২০১৬ টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে সংগৃহীত।

চিকিৎসায় ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে চিকিৎসা শিক্ষার অসাম্যের কারণে।

দুটি রাজ্যে যেখানে সারা দেশের ৩১% জনসংখ্যা সেখানে সারা দেশের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের ৫৮% আসন। অন্য ৮টি রাজ্যে যেখানে সারা দেশের জনসমষ্টির ৪৬% সেখানে মাত্র মোট আসনের ২১%। এই পার্লামেন্টারি কমিটির সদস্যের দেওয়া তথ্য।

প্রতি বছর ৫৫,০০০ চিকিৎসক স্নাতক শিক্ষা শেষ করে ২৫,০০০ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উত্তীর্ণ হয়।

চিকিৎসকের চরম অভাবের কারণ দেখলেই বোঝা যাবে ১৯৪৭ সালে যখন মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা সারা দেশে ছিল ২৩। ২০১৪ সালে সেই সংখ্যা ৩৯৮। ২০১৪ সালে ৪৯,৯৩০জন ছাত্রছাত্রী এই কলেজগুলিতে ভর্তি হতে পারে।

কমিউনিটি হেলথ সেন্টারগুলিতে বিশেষ স্বাস্থ্য কর্মী প্রয়োজন ৮৩%। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা ২৯টি রাজ্যে এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২৫,৩০৮ সেখানে আরও ৩০০০ চিকিৎসক প্রয়োজন।

‍‌যুদ্ধাস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে নরেন্দ্র দামোদর মোদী সরকার ভারতবর্ষকে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শক্তিধর হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। ভারতীয় সমাজের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই চরম সংকটে ভারতবর্ষের অবস্থান পৃথিবীর অন্যতম স্থানে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা বিকারগ্রস্ত চিন্তা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

শিক্ষা, কর্মসংস্থানের পরিস্থিতিও আরও ভয়াবহ। এ ধরনের চরম সংকটের দেশে মুদ্রাহীন অর্থনীতি চালু করার প্
রচেষ্টা আদৌ কখনও সংগতিপূর্ণ হতে পারে? কালো টাকা ধরার নাম — যা পরিপূর্ণ ব্যর্থ — তার ওপর বিদেশে যে পরিমাণ কালো টাকা আছে — তা উদ্ধারের চেষ্টা না করা, বহুজাতিক সংস্থাগুলির বিপুল পরিমাণ কর মকুব করার নীতি পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেসরকারিকরণের নীতি আষ্টেপৃষ্ঠে সমস্যাকে বিপর্যস্ত করার যাবতীয় ব্যবস্থা পাকা করেছে।

এই চরম ও অভাবনীয় পরিস্থিতি দূর করার জন্য চাই ব্যাপক জনজাগরণ — যা সারা দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও শুরু হয়েছে — ব্যাপকতা লাভের জন্য আপ্রাণ সংগ্রামই এই মুহূর্তে বিশেষ কর্তব্য।


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});


(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *