রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে চুলচেরা বিশ্লেষণে কার ভাগ্যের চাকা ঘুরবে।
1 min read
জয়ন্ত বোস, সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ঘন্টা আগেই বাজিয়ে দিয়েছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গে ৭দফায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে।এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ৫ নং রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের নির্বাচনের তারিখ ১৮ এপ্রিল। ২১ দিনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে। চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক পর্যায়ে। কোনো দলই তাদের এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিতে চাইছে না। রণকৌশল তৈরী করে সংগঠনের বুথ স্তর থেকে সৈনিকদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছে প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলো। ২৫ তারিখ সিপিআইএম, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস দলের প্রার্থীরা তাদের দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের সাথে করে মনোনয়নপত্র জমা করেছেন। ২৬ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা করার শেষ তারিখ। তারপরে শুরু হয়ে যাবে মহারণ নির্বাচনী ময়দানে।
২০১৪ গত রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১৩,৮৭,৫২৬ জন। এই সংখ্যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৭,২৪,০১৪ জন, মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৬,৬৩,৪৭৯ জন এবং অন্যান্য ৩৩ জন। ৫ নং রায়গঞ্জ লোকসভা আসনটি ৭টি বিধানসভা অর্থাৎ ২৯ নং ইসলামপুর, ৩০ নং গোয়ালপুকুর , ৩১ নং চাকুলিয়া, ৩২ নং করনদিঘী , ৩৩ নং হেমতাবাদ , ৩৪ নং কালিয়াগঞ্জ এবং ৩৫ নং রায়গঞ্জ এলাকা নিয়ে গঠিত। গত ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যার ৭৯.৮৭ শতাংশ ভোট পোলিং হয়েছিল। চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন সিপিআইএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম, তিনি পেয়েছিলেন ৩,১৭,৫১৫ টি ভোট অর্থাৎ ২৯ শতাংশ ভোট, কংগ্রেসের দীপা দাসমুন্সী পেয়েছিলেন ৩,১৫,৮৮১ টি ভোট অর্থাৎ ২৮.৫ শতাংশ ভোট। বিজেপির প্রার্থী নিমু ভৌমিক পেয়েছিলেন ২,০৩,১৩১টি ভোট অর্থাৎ ১৮.৩২ শতাংশ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পবিত্র রঞ্জন দাসমুন্সী পেয়েছিলেন ১,৯২,৬৩৪ টি ভোট অর্থাৎ ১৭.৩৯ শতাংশ ভোট। গত লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম মাত্র ১,৬৩৪ ভোটে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কংগ্রেসের দীপা দাসমুন্সী কে পরাজিত করে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ১৫৫৩৩৬৩ জন এবং এই সংখ্যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮২৮৩৩৩ জন, মহিলা ভোটার সংখ্যা ৭৬৭২৬২ ও জন এবং অন্যান্য ৭৩ জন। ভোটারদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোটারদের বাস। এমনিতেই রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের এলাকা কৃষি প্রধান অঞ্চল তবে কৃষিতে তেমন লাভজনক না হওয়ায় প্রচুর মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিন রাজ্যে পাড়ি জমায় অর্থ উপার্জনের জন্য। কারণ এতদ অঞ্চলে এখনও অবধি কোনো শিল্প গড়ে উঠে নি বলে। কিন্তু প্রতি বছরই দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভোট ব্যাংকের স্বার্থে পয়সা খরচ করে ভিন রাজ্য থেকে তাদের নিয়ে আসেন ভোট দেওয়ার জন্য, আর প্রতিবার ভোট আসলেই ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া ভোটারদের পরিবারের কাছে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন রাজনৈতিক দলগুলো যে আর তাদের বাহিরে যেতে হবে না কাজের সন্ধানে। এখানেই গড়ে তুলা হবে কলকারখানা। কিন্তু ভোট শেষ হয়ে গেলে কার খবর কে রাখে। গত লোকসভা নির্বাচনের পর ২০১৬তে অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস বামফ্রন্টের জোটে রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের অন্তর্গত ৭ টি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে কালিয়াগঞ্জ, রায়গঞ্জ, ইসলামপুর আসনগুলোতে জয়লাভ করে কংগ্রেস প্রার্থীরা, হেমতাবাদ ও চাকুলিয়া আসনে বামফ্রন্টের প্রার্থীরা এবং করনদিঘী ও গোয়ালপুকুর আসনে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা। এরপরে রায়গঞ্জ লোকসভা এলাকায় এক বিরাট রাজনৈতিক স্রোত প্রবাহিত হয়েছে। এই স্রোতের প্রবাহে একদিকে যেমন বামফ্রন্টের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ গতবারের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখা আবার কংগ্রেস দলের অসংখ্য সেনাপতিদের দল ত্যাগের পর গতবারের দ্বিতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বেও এবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ তেমনি পুরনো সংগঠনের সাথে বিভিন্ন দল থেকে বেরিয়ে আসা নব্য সেনাপতিদের সাংগঠনিক শক্তির সংমিশ্রণের ইমেজ সহ রায়গঞ্জ লোকসভা এলাকা জুড়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীকে দলগত গতবারের চতুর্থ স্থান থেকে প্রথম স্থানে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ, আর বিজেপির কাছে চ্যালেঞ্জ তাদের সাংগঠনিক শক্তির চেয়েও চোরা স্রোত কতখানি কার্যকরী করে উঠাতে পারে।
তবে অংকের শতাংশ হিসাব অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে ২৯-৩১ শতাংশ ভোট যে রাজনৈতিক দল নিজেদের বক্সে পোলিং করাতে পারবে ভাগ্যের চাকা সেই দিকেই ঘুরবে বলে রাজনৈতিক মহলের চেয়েও সাধারণ ভোটারদের সমীক্ষায় একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ব্লক স্তর থেকে শহর অঞ্চলের সাধারণ ভোটারদের একটা বড় অংশের এবারের নির্বাচনে তাদের নিস্তব্ধতার মাঝে লুকিয়ে আছে রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের ভাগ্যের চাকা। গতবারের ১৭.৩৪ শতাংশ পাওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট বাক্সে অতিরিক্ত ১৩-১৪ শতাংশ ভোট টানতে গেলে তাদের সিপিআইএম ও কংগ্রেস দলের ভোট ব্যাংকের উপর নির্ভর করতে হবে। এই শতাংশ ভোট গতদিনে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট থেকে যে সকল সেনাপতিরা তৃণমূল কংগ্রেস দলে যোগদান করে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কাছেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ঐ শতাংশের ভোটাররা তাদের দলবদলে কতটা ইম্প্রেস করেছে সেটাই দেখার। আবার সাংগঠনিক ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে নব্য ও পুরতনিদের আভ্যন্তরীণ সেন্টিমেন্ট ইস্যুগুলোর কারনে ২-৩ শতাংশ ভোট যে তৃণমূল কংগ্রেসের বাক্স থেকে বেরিয়ে না যায় সেটাও ধরে রাখার একটা বড় চ্যালেঞ্জ তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বদের। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বুথ স্তরে , ওয়ার্ড স্তরে এমন কিছু মুখ আছে যাদের নিয়ে প্রার্থীর হয়ে প্রচারে সাধারণ ভোটাররা বিরাগভাজন না হতে পারে সেই বিষয় দেখবার একটা রণকৌশলের চ্যালেঞ্জও থেকে যায় তৃণমূল কংগ্রেস সংগঠনের। এই বিশ্লেষণে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস এই দুটি দল থেকেই সম্ভবত মোট ১৩-১৫ শতাংশ ভোট বেড়িয়ে পরার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনো তাৎপর্যের বিশ্লেষণেই কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের গতবারের পাওয়া শতাংশ ভোটের সাথে অতিরিক্ত শতাংশ ভোট সংযোজন হবে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাই এবারের নির্বাচনে রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি দলের মধ্যে একটা হাড্ডাহাড্ডির লড়াই যে হতে চলেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে চুলচেরা বিশ্লেষণে ভাগ্যের চাকা ঘুরবে তবে কোনদিকে ঘুরবে তাকিয়ে থাকবে জনগন আগামী ২৫ মের নির্বাচনী ফলাফলে।