বাংলা নাট্য জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি শ্রী হরিমাধব মুখোপাধ্যায় – এর প্রতি সম্মাননা জানাতে বিচিত্রার দুইদিনের নাট্য মেলা
1 min readবাংলা নাট্য জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি শ্রী হরিমাধব মুখোপাধ্যায় – এর প্রতি সম্মাননা জানাতে বিচিত্রার দুইদিনের নাট্য মেলা
তপন চক্রবর্তী,কালিয়াগঞ্জ১৬মে:উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ বিচিত্রা নাট্য সংস্থা বাংলা নাট্য জগতের কিংবদন্তি শ্রী হৃমাধব মুখোপাধ্যায় এর প্রতি সন্মাননা জানাতে তাঁরই রচিত এবং নির্দেশিত দুটি নাটকের পুনঃ মঞ্চায়নের আয়োজন করেছে স্থানীয় নজমু নাট্য নিকেতন মঞ্চে গত রবিবার ও সোমবার।এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কলিয়াগঞ্জের দুই বিশিষ্ট নাট্য কর্মী শ্রী বিভূ ভূষণ সাহা এবং শ্রী নন্দ কুমার ঘোষ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বুনিয়াদপুর সহচলী নাট্য গোষ্ঠীর শ্রী ব্রতজীত সাহা। প্রথম দিন মঞ্চস্থ হয় হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের এক অনন্য সৃষ্টি গণেশ গাথা।
অযাত্রা, অপয়া, কুসাইত, ‘ওর মুখ দেখলে যাত্রা নাই’ ভারতীয় সমাজে এই আধুনিক যুগেও এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবধারাটি জনমানসে বহুল প্রচলিত রয়ে গেছে। অনেক জনসচেতনতামূলক প্রচার সত্ত্বেও এই ভ্রান্ত ধারণাকে তার শেকড় থেকে উৎপাটন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ।অযাত্রা বলে যে সত্যিই কিছু হয়না ‘গণেশ গাথা’ নাটকের মাধ্যমে বরেণ্য নাট্যকার শ্রী হরিমাধব মুখোপাধ্যায় সুচারুরূপে মঞ্চে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত নাট্যদল উত্তর দিনাজপুর বিচিত্রা নাট্য সংস্থা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কালিয়াগঞ্জ এর নজমু নাট্য নিকেতনে মঞ্চায়িত করেছে ।
এটি গণেশ গাথা নাটকের ৪৪ তম মঞ্চায়ন। শুরুতে যে সমস্ত বরেণ্য অভিনেতা অভিনেত্রী নাটক এর সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে দীপক পাল মহাশয় প্রয়াত হয়েছেন, শ্রীমতি রিংকি সাহা বিবাহজনিত কারণে স্থানান্তর গমন করেছেন, আরেক বরেণ্য অভিনেতা অশোক দাস মহাশয় শারীরিক অসুস্থতার জন্য অভিনয় থেকে অবসর নিয়েছেন। নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী সমন্বয়ে আজ ‘গণেশ গাথা’ নাটক সুন্দরভাবে মঞ্চায়িত হয়েছে। পুরনো নাটকে অভিনয় বরাবরই এক কঠিনতম কাজ। কিন্তু অভিনেতা অভিনেত্রীগণ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নাটকের মান বজায় রাখতে পেরেছেন। নাটকের শুরুতে মিষ্টির দোকানে অপয়া গণেশের প্রবেশে বিপর্যয় ঘটায়। মনা পোদ্দার ও ধনা পোদ্দার এই দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক জমি নিয়ে বিবাদ ।
সেই বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। গায়ের শ্মশানের তান্ত্রিক জগা ঠাকুরের পরামর্শ গণেশ নামের ছেলেটির মুখ দেখানোর মাধ্যমে মামলা জেতার জন্য উঠেপড়ে লাগে দুই ভাই। কারণ এলাকায় প্রচলিত আছে যে, গণেশের মুখ যে একবার দেখবে তার সমস্ত কাজ পন্ড হবে। স্থানীয় মিষ্টির দোকানে মিষ্টি কিনতে গেলে গণেশের মুখ দেখার ফল স্বরূপ দোকানের মিষ্টির কড়াইতে লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ। এভাবেই নাটকের সূত্রপাত। গায়ের বুড়ো ছেলে বউ-বাচ্চা সকলেই গণেশ নামক অপয়াকে দূরে দূরে ঠেলে রাখে। এমনকি বাচ্চা ছেলেরাও এই অপয়ার সঙ্গে খেলে না। বা কেউ খেলতে যেতে চাইলেও কথা বলতে চাইলেও তাদের মা-বাবা তাদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় ।এমতাবস্থায় গণেশ প্রায় গৃহবন্দী জীবন যাপন করে। স্থানীয় মন্দিরে তার সময় কাটে । মন্দিরে যেসব প্রণামী ভক্তগণ দান করে সেসব কুড়িয়ে নিয়ে এটা ওটা জিনিস কিনে সংসারের খরচ করে ।পিতৃ-মাতৃহীন গণেশ পিসির কাছে মানুষ হয়। পিসি ভিক্ষা করে সংসার নির্বাহ করে। গণেশ যুবক বয়সে হলেও কারো বাড়িতে কাজ চাইতে গেলে মার, গালাগাল খেয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়। কারণ সবাই মনে করে গণেশ অযাত্রা। ওর মুখ দর্শন করলে সমস্ত কাজ পন্ড হবে। এমতাবস্থায় জগা ঠাকুর মনা পোদ্দারকে মামলা জেতানোর জন্য গণেশ কে ব্যবহার করে ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে ধনার বাড়ির সামনে সকালবেলা পাঠায়। যাতে ওর মুখ দেখে ধনার কাজ পন্ড হয়,অর্থাৎ ধনা মামলায় যেন হেরে যায়। এই চক্রান্ত বুঝতে পেরে ধনা আর তার ছেলে নিতাই গণেশ কে টাকা দিয়ে বশ করে মনার কাছে মুখ দেখানোর জন্য পাঠায়, যাতে মনার কাজ পন্ড হয় অর্থাৎ মনা মামলায় হারে। এই টানাপড়েনের মধ্যে গণেশ কে বাঁচাতে এগিয়ে আসে গায়ের আরেক খোড়া তরুণী খিরি। গনেশকে মনে মনে ভালোবাসে তাই তাকে বাঁচাতে চায় সে । সে গণেশ কে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। গণেশ সব বুঝতে পেরে মনাকে জিজ্ঞাসা করে যে মনা এবং ধণা উভয়ই গণেশের মুখ দেখেছে অর্থাৎ তথাকথিত অপয়ার মুখ দর্শন করেছে তাহলে মামলায় যে হারবে তার কাছে গনেশ কুসা, আবার মামলায় যে জিতবে তার কাছে গণেশ সাইত। তার জিজ্ঞাসা একই মানুষ কি করে সাইত এবং কুসাইত হয়। ঘটনা পরম্পরায় গণেশের কাটা লটারিতে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার বাঁধে। সেই টাকার জন্য মনা পোদ্দার এবং ধনা পোদ্দার গণেশ কে বশে আনার চেষ্টা করে । তারা বুঝতে পারে যে আসল ভাগ্যবান এবং সুখী হল গণেশ । গায়ের সবাই বুঝতে পারে গণেশই প্রকৃত ভাগ্যবান লোক ,সে জন্যই সে লটারি জিতেছে। পরিশেষে গণেশ সবার ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয় মনা পোদ্দার এবং ধনা পোদ্দারের পারস্পরিক শত্রুতা ঘুচিয়ে তাদের মধ্যে মিলন ঘটাতে সমর্থ হয়। এবং প্রমাণিত হয় যে সাইত- কুসাইত , পয়া – অপয়া বলে আসলে কিছুই হয় না। নাটকের’মধুরেন সমাপয়েৎ’ ঘটে।রূপসজ্জা শিল্পী শ্রী প্রদ্যুৎ তালুকদার, আলোকশিল্পী শ্রী কমল বসাক তাদের কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আজকের এই অনুষ্ঠানের শুরুতে বিচিত্রার পক্ষ থেকে এই দুই শিল্পীকে সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়।শব্দ প্রক্ষেপণে শ্রী ষষ্ঠীচরণ দাস সাবলীল।গণেশের চরিত্রে শ্রী চন্দন চক্রবর্তী অত্যন্ত দক্ষতা দিয়ে অভিনয় করেছেন।দুই পোদ্দার শ্রী শান্তনু দাস ও শ্রী তপন মজুমদার মনোগ্রাহী অভিনয় করেছেন। জগা ঠাকুরের ভূমিকায় শ্রী অরিন্দম ঘোষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। লটারি বিক্রেতার চরিত্রে নবরূপে অভিনয় করেছেন শ্রী প্রবীর কুমার দেবনাথ যিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা শ্রী অশোক দাস মহাশয়ের পরিবর্তরুপে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন।ক্ষিরির চরিত্রে শ্রীমতি প্রিয়া দে সাবলীল তবে কণ্ঠস্বর আরো জোরালো হলে ভালো হবে। নিতাই চরিত্রে শ্রী রাজশেখর চট্টোপাধ্যায় এবং পিসির চরিত্রে সংগ্রামী ভট্টাচার্য্য ভাল অভিনয় করেছেন। বুধা চরিত্রে শ্রী নিখিল দাস তাঁর শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও দাপুটে অভিনয় করেছেন। দুই শিশুশিল্পী অনন্ময় ঘোষ ও অংশুময় ঘোষ,নতুন অভিনেতা মিন্টু,অয়ন,আরমান প্রতিভার ছাপ রেখেছেন।এ নাটক দর্শককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। নাটক শেষে দর্শক মঞ্চে এসে স্বতস্ফূর্ত প্রশংসা করেছেন। মজার ছলে সমাজের এক চরম বাস্তবকে মনোগ্রাহী করে উপস্থাপন করার জন্য নির্দেশক ও সকল অভিনেতা – অভিনেত্রী দর্শকের প্রশংসা ধন্য হয়েছেন।