December 26, 2024

কবিগুরু লহ প্রণাম

1 min read

কবিগুরু লহ প্রণাম

কৃতিমান বিশ্বাস  গ্রীষ্ম আসে কালবৈশাখীর পিঠে শাওয়ার করে। জীর্ণ মরা পুরাতনকে দুমড়ে ভেঙে আসে বৈশাখ। ঝড়ো হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যায় তদরকারি সব জঞ্জাল আবর্জনা। কখনো কাঠফাটা রোদ বা কখনো আবার ফুরফুরে হাওয়া হয়ে বৃষ্টি- প্রকৃতির এই দোদুল্যমান লীলাখেলায় মেতে ওঠে বৈশাখ মাস। বৈশাখের ঠিক শেষ লগ্নে অর্থাৎ ২৫ এ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম তিথি এবং ওই বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীদের মনে জন্ম নেয় আনন্দ- মেতে ওঠে বাঙালিরা সাংস্কৃতিক আড্ডায় এবং ওই দিন সকাল থেকেই রবীন্দ্র মূর্তি তে মাল্যদান ও শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালির রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব।

ঐদিন কবিগুরুকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে বাঙালির কন্ঠ থেকে নির্গত হতে থাকে কবিগুরুর গান ও কবিতা- যা ঐদিন মাতিয়ে রাখে সমগ্র বাংলাকে। এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে বাঙালির মনে বাসা বাঁধে না নানা স্বপ্ন নানা প্রস্তুতি।১২৬৮সালের বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখ শুভ তিথিতে মাতা সারদা দেবীর কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটবেলা থেকে ঠাকুর পরিবারে অত্যন্ত শাসনে তিনি বড় হয়েছেন। বিশ্বকবি ছোটবেলা থেকেই বিদ্যা ক্ষেত্রে ছিলেন পারদর্শী। কিন্তু প্রথাগত বিদ্যা তার কাছে ছিল এক বিশেষ অপছন্দের বিষয়। তাই তিনি বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া না করে ঘরে বসেই চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। পিতার শিক্ষাই তাকে যোগাতো অনুপ্রেরণা তাই পিতার প্রদত্ত শিক্ষাই তিনি গ্রহণ করেছিলেন এবং সমগ্র জীবন ধরে তিনি তা অনুধাবন করে এসেছেন। তিনি তার সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে গৌরবান্বিত করেছেন। স্বয়ং দেবী স্বরস্বতীর বর প্রদত্ত সন্তান ছিলেন কবিগুরু। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। একাধারে যেমন কবি ছিলেন ,তেমনি বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ছিলেন তেমনি অপূর্ব চিত্রশিল্পী ছিলেন তিনি। নানা ক্ষেত্রে সমানভাবে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ডালি ডালি গান ও কবিতা উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষকে তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র টি তিনি তুলে ধরতেন তার কলমের মাধ্যমে। তিনি তাঁর কবিতা ও গানের সোনালী লাইনের মাধ্যমে তৎকালীন তরুণদের মনকে উজ্জীবিত করতে ও তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন মন থেকে কুসংস্কার দূর করে আশার আলো জ্বালতে তিনি বলেছিল:-
“ওরে নতুন যুগের ভোরে
দিসনে সময় কাটিয়ে বৃথা
সময় বিচার করে।
চালায় চালায় জাগবে জয়ের ভেরী
পায়ের বেগে পথ কেটে যায়
করিস না আর দেরী”।
তৎকালীন সমাজে নারীদের এক বিশেষ অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো। তৎকালীন সমাজে নারীরা প্রতিনিয়ত নিপীড়িত অবহেলিত হয়ে আসতো। তাদের প্রাপ্য সম্মান তাদের দেওয়া হতো না। সমাজের এইরূপ নিষ্ঠুর আচরণে নারীদের মনে জন্মগ্রহণ করেছিল এক চরম অন্ধকার। পিছিয়ে পড়া সমাজ ব্যবস্থার কুনজর হরণ করেছিল নারীদের স্বাধীনতা। এই অবস্থায় কবিগুরু নারীদের মনে জোগালেন সাহস। তার কলমের মধ্যে নারী এসেছে সৌন্দর্য নির্ভরশীলতা সহনশীলতা ও অনুগত্যের প্রতি মূর্তি হিসেবে তিনি নারী সম্বন্ধে লিখেছেন:-
” শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে।
বসি কবিগণ সোনার উপমাসূত্রে বুনেছে বসন।
সঁপিয়া তোমার পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না;
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার
রেন রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার
লজ্জা দিয়ে সজ্জা দিয়ে দিয়ে আবরণ
তোমার দুর্লভ করি করেছে গোপন
পড়েছে তোমার পরে প্রদীপ্ত বাসনা
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা”।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় এক বিশেষ আধ্যাত্মিক চেতনা। ঈশ্বরের প্রতি অগাধ ভক্তি চেতনা সব সময় ছিল তার মধ্যে বিরাজমান। তিনি তার গান ও কবিতার মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন -ঈশ্বর কোন বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ থাকে না যেখানে:-
” তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙ্গে করেছে চাষা চাষ
পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ, ঘাঁটছে কারো মাস
রৌদ্রে জলে রয়েছেন সবার সাথে” ।
তিনি সঙ্গী হয়ে রয়েছেন সবার সাথে কারণ
” ভজন মন্দিরে তব
পূজা যেন নাহি রয় থেমে
মানুষ করো না অপমান
যে ঈশ্বরের ভক্তি করো
হে সাধক মানুষের প্রেমে
তারই প্রেম করো সম্প্রমান”।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও কবিগুরুর এক বিশেষ অবদান লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিপ্লবী হয়ে লড়াই করে গেছেন তার কলমের মাধ্যমে। তিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে উদ্দীপ্ত করেছিলেন সেই সময় সাধারণ মানুষকে ও তাদের মনোবলকে দৃঢ় করেছিলেন। শুধু এই পার বাংলায় নয় ওপার বাংলায়ও কবিগুরু সমানভাবে জনপ্রিয়। ভারতবর্ষ সহ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা হলেন তিনি। বাংলাদেশেও কবিগুরুর জন্মদিনের এই বিশেষ দিনটিতে কবিগুরুকে বিশেষ সম্মান জানিয়ে ছোট বড় নানা রকম সাংস্কৃতিক আড্ডায় মেতে ওঠে বাংলাদেশের জনগণ ও। কবিগুরু ছিলেন বাস্তববাদী ও নানারকম সমাজের বাস্তব চিত্র গুলির প্রাণপ্রতিষ্ঠা হতো তার কলমের মাধ্যমে। বাংলা বিখ্যাত কৃষি শিল্পের জন্য।কথা তে আছে-” শস্য-শ্যামলা বাংলা নানা বৈচিত্র্যে ভরা”। তাই তিনি কৃষকদের কথা ভেবে এবং বাংলার কৃষি শিল্প কে বাঁচিয়ে রাখতে কৃষকদের জন্য চালু করেছিলেন কৃষক- ঋণ। কবিগুরুর জন্মতিথি শুভলগ্নে সকাল থেকেই মানুষ বাঙালি পোশাক পরিধান করে মগ্ন হয়ে থাকে কবিগুরু কে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে। পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব। এই মহামানবের জন্মদিন উদযাপন মানে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়া। তাই আজ তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করে সারাবিশ্ব বাঙালি। কবিগুরু নিজ কর্মের মাধ্যমে সূচনা করে গেছেন একটি নতুন কালের- একটি নতুন সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই সুদক্ষতার সাথে তিনি বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলাতে শুরু করেন। তার পরিণত হওয়ার সাথে সাথে পরিণত হয়েছে বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও ঐতিহ্য। তাই তিনি বাঙালির কাছে কবিগুরু। এবং তিনি তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টির জোরে তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে আলোর সঞ্চালন করেছিলেন। তাই তিনি আজও বাঙালির মনের মণিকোঠায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসে রয়েছেন। কিন্তু আজ এই মহামারী করোনাভাইরাস এর নজরে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে এক চরম বিপর্যয়। হারিয়ে ফেলেছে তারা তাদের বেঁচে থাকার রসদ। বহু মানুষের জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতিমুহূর্তে মানুষ এক প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে এ মরণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে- লড়াই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এই মহামারীর সাথে কবিগুরুর কবিতার সোনালী লাইনগুলি আজ অনুপ্রানিত করে চলেছে সমগ্র মানব সভ্যতাকে এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। তিনি বলেছিলেন:-
” মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গে তে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয় ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা
…… কে সে, জানিনা কে। চিনি নাই তারে।
শুধু এইটুকু জানি, তারই লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবজাতির যুগ হতে যুগান্তর পানে,
ঝড়ঝঞ্জা- বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে অন্তর প্রদীপ- খানি
কে, সে চিনি নাই তারে……!

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *