গল্প
থানা থেকে মোটরসাইকেলে পুলিশ এসেছে দুইজন। বিকেলের সোনা রোদ ছড়িয়ে নিলীমায় নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছে তপ্ত ক্লান্ত দিবাকর। ছনের ঘরে অন্ধকার ঘেঁষেছে আগেই। হেরিকেনের চিকনিটা মাজতে ঘর থেকে বের হচ্ছিল রোখসানা, রশিদুলের একমাত্র বোন। মোটরসাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে আসে এসআই ফয়েজ। রোখসানা থমকে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। সালামের উত্তর দিয়ে ফয়েজ জিজ্ঞাসা করে রশিদুল তার কি হয়?সাতপাঁচ না ভেবেই রোকসানা জবাব দেয় রশিদুল তার একমাত্র বড় ভাই।
তোমার বাবা কোথায়?
এবার রোখসানার মুখে ভেসে ওঠে বিষন্নতার ছাপ। ঋদ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয় তার বাবা নেই। মুক্তিযোদ্ধা বাবা তিন বছর হলো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
এবার রোখসানার মুখে ভেসে ওঠে বিষন্নতার ছাপ। ঋদ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয় তার বাবা নেই। মুক্তিযোদ্ধা বাবা তিন বছর হলো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
ফয়েজ এবার কি বলবে খুঁজে পায়না। নিজেকে সংবরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ওসি সাহেব তাকে বিশ্বাস করে এই অপ্রত্যাশিত সংবাদটি পৌঁছে দিতে পাঠিয়েছে। আর সেই ফয়েজ এবার বাকরুদ্ধ হয়ে যায় ঘটনাস্থলে এসে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল তার। কিন্তু তার চেয়েও অসহায় এই রোখসানার পরিবার।
বয়স খুব বেশী না হলেও ১৫/১৬ বছর ঠিকই হবে রোখসানার। টানা চোখ, লম্বা বেনীর চুল, নাকটা ঠিক বাঁশীর মতো। গায়ের রং দুধে আলতা। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে এবার এসএসসি পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে সে। পাশের গ্রামের এক নতুন কলেজে মানবিক বিভাগে পড়ছে।
ফয়েজের চাকরীর বয়স সবে তিন বছর। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছে। কিন্তু পছন্দের পাত্রী না পাওয়ায় সে বিয়ে নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রোখসানাকে জিজ্ঞাসা করলো তার ভাই কবে বাড়িতে এসেছিল?এবার রোখসানা একটু ভাবতে লাগলো। উল্টো প্রশ্ন করে বসলো, এতো কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?আপনি বসেন আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি। কিন্তু বাদ সাধলেন ফয়েজ। বললেন প্লিজ তোমার মাকে ডাকবে না। যদি পারো তোমার আশপাশের কোনো পুরুষ লোক ডাকো, জরুরী কথা আছে।
রোখসানা পাশের বাড়ী থেকে এক বৃদ্ধ চাচাকে ডেকে আনে। সালাম দিয়ে কথা বলেন এসআই ফয়েজ। কথায় কথায় জানতে পারেন রোখসানার বাবা ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। নিজের চিকিৎসা করতেই সর্বস্ব খুইয়েছেন। যা ছিলো শেষ সম্বল সেটুকুও বিক্রি করে রশিদুলকে পুলিশের চাকুরী দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন রশিদুল যা বেতন পায় তা দিয়েই কোন রকম দিন চলে। বিবাহযোগ্য বোন রোখসানার একটা বিহিত করতে পারলে রশিদুলের কিছুটা স্বস্তি হয়।
ঘর থেকে মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হয় রশিদুলের মা। পোষাক পরিধান করা পুলিশ দেখে আঁৎকে উঠে জিজ্ঞাসা করেন কি হয়েছে বাবা?আপনারা আমার বাড়িতে কেন?ওর বাপের ব্যাংকের লোনের টাকাতো রশিদুল মাসে মাসে শোধ করে দিচ্ছে। এখন আবার কি হলো?
ফয়েজ এবার আরো বেশি শক খান। কিভাবে এই অসহায় পরিবারের নিকট এমন কঠিন একটা খবর দিবেন বুঝতে পারেন না। এগিয়ে যান রশিদুলের মায়ের কাছে। তাকে মা ডেকে শান্ত হতে বলেন। রশিদুল যেহেতু আপনার ছেলে, আর আমিও আপনার ছেলের সাথে পুলিশের চাকুরী করি তাই আপনিও আমার মা। আমার মা দুরে থাকে, আমি আপনার কাছে থাকি তাই আপনাকে মা ডাকার অনুমতি দিলে যারপর নাই খুশি হই। এবার রশিদুলের মা ফয়েজের হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে ‘সত্যি করে বলোতো আমার রশিদুলের কি হয়েছে?’
এবার এক আকাশ কষ্ট ভেঙে পড়ে ফয়েজের মাথায়। মায়ের মন ছেলের অমঙ্গল জেনে যায় অগোচরেই। উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ‘আমার রশিদুলের কি হয়েছে বললেনা!’
না তেমন কিছু হয়নি। একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি শান্ত হোন আমি সব বলছি।
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রশিদুলের মা। পৃথিবীতে আর কেউ থাকবেনা রশিদুলের কিছু হলে। কি হয়েছে জানতে চান।
ফয়েজের চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিভাবে উপস্থাপন করবে বিষয়টি খুঁজে পায়না। বৃদ্ধ চাচাকে নিয়ে বাড়ীর বাইরে চলে যায় ফয়েজ। সব খুলে বলেন তাকে। সাথে রোখসানা এবং তার মায়ের দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেন।
বৃদ্ধ চাচা ফয়েজকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধ ফিরে যান রোখসানার মায়ের কাছে। রশিদুলের মাকে জানিয়ে দেয় তার এক ছেলে হারিয়ে গেলেও আরেক ছেলে তাদের দায়িত্ব নিতে এসেছে। এবার বিদায় এবং বরণ করে নেয়ার পালা। এক পাহাড় দুঃখ আর এক সাগর জল নেমে আসে সদ্য মৃত কনস্টেবল রশিদুলের মায়ের চোখে। রোখসানা দৌড়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে বিলাপ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অন্ধকারে নিভু নিভু হেরিকেনের আলো হাতে আশপাশের বাড়ির মানুষেরা ছুটে আসে তাদের কান্নার আওয়াজ শুনে। পুরো বাড়িতে নেমে আসে শোকের মাতম।
উঠানের কোনে বসে থাকে ফয়েজ, কখন রশিদুলের লাশ আসবে সেই প্রতীক্ষায়।