October 4, 2024

কালিয়াগঞ্জ এর মা বয়রার আরাধনা ধর্মের বেড়া জাল কাটিয়ে মুসলিম দারোগার হাতেই

1 min read

কালিয়াগঞ্জ এর মা বয়রার আরাধনা ধর্মের বেড়া জাল কাটিয়ে মুসলিম দারোগার হাতেই

পিয়া গুপ্তা চক্রবর্তী, উত্তর দিনাজপুর  “আমরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান”,নজরুলের এই মন্ত্রকে পাথেয় করেই একদা ধর্মের বেড়া জাল ভেঙে মুসলিম দারোগা সাহেবের হাতেই নির্মাণ হয় উত্তরবঙ্গের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কালিয়াগঞ্জ এর মা বয়রার মন্দির।সাম্প্রতিক কালে আল্লাহ ও ঈশ্বরের মাঝে বিভেদ তৈরি করে একশ্রেণীর মানুষ যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে চলেছে ,সেই সময় দাড়িয়ে অবাক করে দেয় হিন্দু ও মুসলিমের সেই ঐক্য বদ্ধ মিলনের প্রতীক মা বয়রা মন্দিরের ইতিহাস।এমন গল্প শুনলে হয়তো মৌলভী মোল্লারা অনেকে তেড়ে এসে নেহাৎই কাফের বা ফতোয়া জারি করবেন।কারণ তারা তো ঈশ্বর ভাগেই বিশ্বাসী।উল্লেখ্য সালটা ছিল ১৯৩২, উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানায় তখন নবনিযুক্ত হয়েছেন নতুন দারোগা নজমূল হক।দারোগা মশায়ের স্বপ্নেই নাকি একদিনহাজির হোন মা বয়রা কালী স্বয়ং।

 

কথিত আছে দারোগা নজমুল হকের একমাত্র পুত্র সেই সময় প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। দারোগা বাবু তখন মায়ের কাছে মানত করেন পুত্রের সুস্থতার জন্য । পুত্র সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি মায়ের মন্দির নির্মাণ করবেন এমন দৃঢ় সংক্লপে আবদ্ধ হন। কিছুদিন পর পুত্র সুস্থ হয়ে গেলে মা বয়রা আদেশেই সেই সময় বয়রা মন্দিরের প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় আসে দারোগা মশাইয়ের। নিজে মুসলিম হলেও তার কিন্তু সব ধর্মের প্রতি ছিল সমান শ্রদ্ধা।তাই জাত পাতের সীমানা পেরিয়ে তিনি মন্দির নির্মাণ কাজ যোগ দেন।মন্দির নির্মাণের অর্থ সংগ্রহ করতে রাত দিন কাজের ফাকে ফাকে তিনি বেড়িয়ে পড়তেন চাঁদা সংগ্রহ করেতে ,এবং মন্দির নির্মাণের বাকি অর্থ জোগাড় হয় এক লবণ গাড়ির নিলাম থেকে। এলাকা বাসীর দানের অর্থ দিয়ে আয়োজন হয় পুজোর সমস্ত সামগ্রীর।

১৯৩০-এ দারোগা নজমুল হক টিনের চালাঘর তৈরি করে পুজোর সূচনা করলেও ১৯৯৮ সালে ভক্তদের চেষ্টায় এবং অর্থে গড়ে তোলা হয় মা বয়রার অষ্টধাতুর মূর্তি।তবে এখানেই কিন্তু এই মন্দিরের ইতিহাস শেষ নয়, মা বয়রা মন্দির কে ঘিরে রয়েছে অজানা হাজারো ইতিহাস।কালিয়াগঞ্জের দারোগা বাবুর অনেক আগে এই বয়রা কালির পুজোর প্রথম সূচনা হয় ডাকাত দলের সর্দারের হাতেই।কথিত আছে মা কালীর সঙ্গে ডাকাতদের যোগ বেশ আত্মিক। মা বয়রা মন্দিরের পাশেই বয়ে গেছে খরস্রোতা শ্রীমতী নদী।শ্রীমতি নদী দিয়ে নৌকা করেই একদা দূর-দূরান্ত থেকে আসতেন বণিক বেশভূষা পরিহিত ডাকাতরা।অন্ধকারে বয়রা গাছের তলায় ডাকাতদের গোপন আস্তানায় নাকি চলত মা বয়রা কালীর আরাধনা। শ্রীমতী নদীর পাশে ভরা ঝোপজঙ্গলের আড়ালে তক্কে তক্কে থাকত ডাকাতদল। বণিক রা কাছে ভিড়লেই চলতো আক্রমণ। বণিকদের পণ্যে হানা দিয়ে লুঠ হয়ে যেত সমস্ত সামগ্রী। কিন্তু ‘মায়ের’ আশীর্বাদ না থাকলে ডাকাতি ব্যর্থ হবে। তাই নদীর পাশের বয়রা মন্দিরেই নাকি পুজো দেওয়ার রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়।ডাকাতদের বয়রা গাছের নিচে সেই পুজোই কালক্রমে দারোগা সাহেব নজমুল হকের মন্দির প্রতিষ্ঠার পর আড়ম্বরে সূচনা হয়।উপরে কাঠের খুঁটির উপর টিনের চালা দিয়ে ও চারিদিকে বেড়া দিয়ে প্রথম মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় নজমুল হকের হাত ধরেই। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষ এপার বাংলায় কালিয়াগঞ্জ এ আসার পর জনবসতি গড়ে ওঠে। সেই সময় কালিয়াগঞ্জ এর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত কনক শিকদার সহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী দের উদ্যোগে প্রথম কালিয়াগঞ্জ মা বয়রা কালির পাকা মন্দির নির্মাণ হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ বেশ কিছু বছর পর ১৯৯৮ সালে কালিয়াগঞ্জ পৌরসভার প্রয়াত পৌরপিতা অরুণ দে সরকারের উদ্যোগে ১৯৯৮ সালেমা বয়রার মূর্তিটি অষ্টধাতু তে নির্মাণ করা হয়। মূর্তি নির্মাণ করেন কৃষ্ণনগর থেকে আগত শিল্পী মৃগাঙ্ক পাল। এক সাক্ষাৎকারে এই কথা গুলো বলেন কালিয়াগঞ্জ বয়রা কালীর পুজো কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিদ্যুৎ বিকাস ভদ্র।

তিনি আরো বলেন বর্তমানে বয়রা কালীর যে মন্দির টি রয়েছে তার বয়স ৬০ বছরের উপর ফলে মন্দির টি অবিলম্বে সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বর্তমান কমিটি এবং কালিয়াগঞ্জ এর সহৃদয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় মায়ের পুজোর পরেই এই মন্দিরেরসংস্কারের চিন্তা ভাবনা চলছে।সম্পাদক বিদ্যুৎ বাবু জানানপুজোর দিন মাকে সাজানো হয় সোনার গয়নায়। ভোগে থাকে তিন রকমের সব্জি এবং পাঁচ রকমের মাছ ভাজা। পূজোর দিন রাত্রিবেলায় নাকি মা বের হোন ভক্তদের মাঝে। অনেকেই নিঝুম রাস্তায় শুনেছেন মায়ের নূপুরের শব্দ। মায়ের পূজোয় অংশ নেন এলাকার অন্য ধর্মের লোকেরাও।

সরকারি নিয়ম মেনে পুজোয় বন্ধ হয়েছে বলি প্রথা।নজমূল সাহেবের উদারতা এখনো পথ দেখায় বর্তমান প্রজন্মকে। পরবর্তীতে দারোগা নজমুল হকের নামেই কালিয়াগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘নজমূ নাট্য নিকেতন’।ওদিকে বয়রাকালীর নামের পিছনে রয়েছে দু’টি ভিন্ন মত। কারও মতে এই কালীমন্দিরের পাশে এক সময় বয়রা গাছ ছিল। যার থেকে বয়রাকালী নামের উৎপত্তি। আরেকটি মত বলে এই কালী বধির অর্থাৎ বয়রা।দীপান্বিতা অমাবস্যায় বিশেষ দিনে মা বয়রার পুজো হয়ে থাকে কালিয়াগঞ্জ এ। সে দিন মাকে স্বর্ণালঙ্কারে সাজিয়ে তোলা হয়। পরানো হয় সীতাহার, মণিহার, কোমরবিছা, রতনচূড়, কানপাশা প্রভৃতি। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বিহার থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন এই পুজোতে সামিল হতে।তবে অবশেষে একটাই কথা বলাই বাহুল্যমহাশক্তির আরাধনাই হোক কিংবা মহরম বা ইদ উৎসব হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এই ছবি গুলো আজও উঠে আসে গ্রাম বাংলার প্রাচীন বহু পুজোর ইতিহাস ঘটলেই।নিত্য নতুন থিমের পুজোই যখন জমজমাট কালিয়াগঞ্জে বিগবাজেটের পুজো গুলোই, তখন কালিয়াগঞ্জ এর একমাত্র মা বয়রা কালী পুজোর থিম হয় আচার নিষ্ঠা ও ভক্তি রসের মাধ্যমে মায়ের পুজো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *