October 26, 2024

উত্তর বঙ্গের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ধনকোল হাট তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে।

1 min read

জয়ন্ত বোস, বর্তমানের কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ” হাট ” কবিতা মনে পরে নিশ্চয়ই, ভুলে যাওয়ার নয়। সেই কবিতাটির শব্দচয়নে লিখতে ইচ্ছে করে ” কুমোর পাড়ার গরু গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি , গাড়ি চালায় হরিমোহন, সঙ্গে থাকে ছেলে মদন। হাট বসেছে সোমবারে, কালিয়াগঞ্জের  শ্রীমতী  পারে …….”। 

উত্তরবঙ্গ , পার্শ্ববর্তী বিহার, আসাম রাজ্যের মধ্যে এক কালে লঙ্কার নির্দিষ্ট বেচাকেনার স্থল বলতেই ধনকোল হাট সাথে গরু কেনাবেচা। বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সাপ্তাহিক  সোমবার করে এই ধনকোল হাট হয়ে আসছে ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই। অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুরের জমিদার স্বর্গীয় নগেন্দ্র বিহারী রায়চৌধুরী, স্বর্গীয় গির্জা বল্লভ রায়চৌধুরী, স্বর্গীয় মনিন্দ্রনাথ ভৌমিক মহোদয়দের উত্তরাধিকারীগনের এজমালি সম্পত্তির একটি অংশ এই  ধনকোল হাটের জায়গা। ধনকোল হাটে একটা সময়ে লাখো লোকের  সমাগম ঘটতো বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বেচাকেনার মাধ্যমে।

 অবিভক্ত দিনাজপুর, পার্শ্ববর্তী মালদা, মুর্শিদাবাদ, দার্জিলিং জেলার এমনকি পার্শ্ববর্তী বিহার,আসাম রাজ্যের মানুষ সেইসাথে কালিয়াগঞ্জ , ইটাহার, রায়গঞ্জ এলাকার বিস্তির্ণ অঞ্চলের সাধারণ ব্যাবসায়ী , সাধারণ মানুষের সমাগমে ধনকোল হাটের গমগমের আওয়াজে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি হাটের জৌলুস এক আলাদা মাত্রা পেত। কি পাওয়া যেত না এই হাটে। নিত্যপণ্যের সব জিনিসপত্রের সাথেই সব্জি, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, গরু, ছাগল, ধান,পাট, গম,লঙ্কা, কাঠের সরঞ্জাম, কাপড়ের দোকান, সোনা রূপা, কাঁসা পিতলের দোকান আরো অনেক অনেক কিছুই শোভা পেত এই হাটের বিস্তির্ণ পরিসরের ধনকোল হাটে।

 কালিয়াগঞ্জের শ্রীমতী নদীর ধারে বর্তমানের ধনকোল হাট ৭০ শতাংশ পৌরসভার এবং ৩০ শতাংশ পঞ্চায়েত স্তরে সীমাবদ্ধ। একটা সময় রবিবারের মাঝরাত থেকেই আসা শুরু হতো দুরদুরান্ত থেকে এই হাটের ব্যাবসায়ীদের। কি শীত,গ্রীষ্ম ,বর্ষা সব ঋতুতেই হাটে সমাগমের কোনো খামতি থাকতো না। সেই ধনকোল হাটের ঐতিহ্য আজ হারিয়ে গেছে, হারাতে চলেছে হাটের অস্তিত্ব। হাট চত্ত্বরে নিরাপত্তার বিষয়টিও হাট মালিক কর্তৃপক্ষগন গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। যার জন্য বছর দুই আগে হাট সীমানায় রাতের অন্ধকারে কতিপয় দুষ্কৃতী এক ১০ বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলে রেখেছিল। জমিদার প্রথার অবলুপ্তি ঘটলেও সেকালের জমিদারদের বংশোদ্ভূত আজকের প্রজন্মের তত্বাবধানে ধনকোল হাটের পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতেই। এদের মধ্যে ডাবলু রায়চৌধুরী, সন্টু রায়চৌধুরী, বিথিকা ভৌমিক,গুডডা ভৌমিক তাদের অংশীদারিত্বের প্রতিনিধিগন হাট পরিচালনার দায়িত্বে।

 অনেকদিন আগে থেকেই হাটের রক্ষনাবেক্ষণের অভাব চলতে থাকায় ধনকোল হাটের জৌলুস শেষ হয়ে গেছে। হাটের থেকে লাখ লাখ  টাকার রোজগার হয়েছে কিন্তু হাটের উন্নয়নে কিছুই হয় নি। হাটের মধ্যে সেই আমলের অনেক পুরানো বৃক্ষছেদন হয়েছে কিন্তু ছায়ার জন্য নতুনভাবে কোনো বৃক্ষরোপণ হয় নি । বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের জন্য উন্নত ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরী করতে ব্যার্থ হাটের পরিচালন কর্তৃপক্ষ। হাটের মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে কোনো শৌচাগারের ব্যাবস্থা করা হয় নি। এতে বিভিন্ন দুরদুরান্ত থেকে আগত হাট করতে আসা মানুষদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় , বিশেষ করে মহিলাদের। হাটের পরিচালন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মালিকপক্ষ তাদের নিজেদের ওয়ারিশদের কাছ থেকে পাওয়ার নামায় দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে একক সিদ্ধান্তে ওয়ারিশদের না জানিয়ে অনেকদিন থেকেই হাটের জমি বিক্রি করে মোটা টাকা পকেটে পুরে হাটের সীমানাকে দিন দিন সঙ্কুচিত করে ফেলেছেন। বিক্রি অর্থ জমিদার আমলের ” পত্তন ” পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে। এতে করে হাটের বর্তমান দেখভাল করা মালিক পক্ষের কর্তৃপক্ষরা নিজেদের আর্থিক লোভের স্বার্থে পত্তন দেওয়ার নামে যে মোটা টাকায় তাদের হাটের জমি অন্যদের কাছে বিক্রি করছেন সেটা সম্পন্ন সরকারের রেভিনিউ কর কে ফাঁকি দিয়েই। হাট পার্শ্ববর্তী কয়েকজন সচেতন নাগরিক এই ব্যাপারে হাটের মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন বহু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধনকোল হাটের স্বার্থে । সচেতন এই নাগরিকদের মধ্যে একজন প্রশ্ন তুলেছেন কিভাবে ভূমি দপ্তরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবং সেই দপ্তরের বিনা অনুমতিতে কিছুদিন আগে ধনকোল হাটের গরু হাট সংলগ্ন জমি থেকে লাখ লাখ টাকার মাটি কেটে বিক্রি করে পুকুর তৈরি করে ফেললেন হাট মালিক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যেই হাটের উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে হাট ব্যাবসায়ী সমিতি হাট মালিকদের কাছে ৯ দফা দাবি নিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করে। ঐতিহ্যবাহী বহু প্রাচীনকালের ধনকোল হাটের ঐতিহ্য যে হারিয়ে যেতে বসেছে তার বলার অপেক্ষা রাখে না। এ নিয়ে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এতদ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে , তবে হাটের ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যার্থ হাট মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে সকলের ক্ষোভ, বিক্ষোভের ঢেউ কোনদিন যে বিশাল আকারে ধনকোল হাটে আছরে পরবে এই নিয়ে এলাকার তথা কালিয়াগঞ্জের  সচেতন নাগরিকরা আশঙ্কায় আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *