জয়ন্ত বোস, বর্তমানের কথা। লোকসভা নির্বাচন ঘিরে সমগ্র দেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও চলছে জাতীয় উৎসব। প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলো এই উৎসবে সামিল হয়েছে প্রতিটি কেন্দ্রে নিজেদের মনোনীত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার রণকৌশলে। আর পশ্চিমবঙ্গ এর ব্যাতিক্রম নয়। সাত দফার নির্বাচনী নির্ঘণ্টে ইতিমধ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন শেষ হয়ে তৃতীয় দফার প্রস্তুতি পর্ব শেষ পর্যায়ে। গতকাল বালুরঘাট লোকসভা আসনের নির্বাচনী জনসভায় বিজেপি প্রার্থীর সমর্থনে বুনিয়াদপুরে অনুষ্ঠিত হলো নরেন্দ্র মোদীর প্রচার সভা। আর এই সভাকে ঘিরে দেখা গেল এক অপ্রত্যাশিত রায়গঞ্জ লোকসভা নির্বাচনী এলাকার মানুষের উক্ত সভায় উপস্থিতির ঢল
। শয়ে শয়ে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে চেপে সকাল থেকেই এক নতুন উদ্যোমের উন্মাদনায় মোদির সভাস্থলে মানুষজনের যাত্রা। নির্বাচন হয়ে যাওয়া রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের অন্তর্গত এলাকার মানুষ শুধু নয় তার সাথে মালদা ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অগণিত মানুষের ঢল। তাই নরেন্দ্র মোদীর সভাকে ঘিরে মানুষের এত উন্মাদনা রহস্যের নেপথ্যের খোঁজে আজকের প্রতিবেদন।
যেকোনো দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে পোস্ট মর্টেম করে মৃত্যুর আসল রহস্যভেদ উন্মোচন করার একটি মেডিক্যাল প্রসেস আছে। ঠিক তেমনি রাজনৈতিক স্তরেও নির্বাচনী ফলাফলের পর নির্বাচনে জিততে না পেরে সেইসকল প্রার্থীদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো পোস্ট মর্টেম করতে বসে এলাকা ভিত্তিক। হার জিততো আছেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সভাকে ঘিরে হঠাৎ করেই এই লোকসভায় মানুষের উন্মাদনার বন্যা কেন। বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে এই উন্মাদনার রহস্যভেদ প্রকাশিত করার চেষ্টা করলাম আজকের এই প্রতিবেদনে।
এই উন্মাদনার তাপে কপালে ভাঁজ পরতে শুরু হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বদের কপালে। ৩৪ বছরের বাম শাষনের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক নতুন সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে। প্রথম পাঁচ বছর পার হয়ে যায় এই পরিবর্তন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকাঠামোর রূপ সাজানোর মধ্যে দিয়ে। তারপর ২০১৬ সালে পুনরায় রাজ্যের মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাংলার উন্নয়নে অগ্রনী ভূমিকা নেন। কিন্তু রায়গঞ্জ লোকসভা আসনের নির্বাচনী এলাকার অধিকাংশ মানুষজন ঠিক তেমন ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার নব উন্নয়নের যাত্রাপথে সামিল হতে পারেনি তার কারন এই এলাকাটি ২০১৭ পর্যন্ত কংগ্রেস ও বামপন্থী নেতৃত্বের সংমিশ্রণের মাটি ছিল।
তথাপি ২০১৫ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তৃতীয় স্থান দখল করে অবিশ্বাস্য ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস কে ভোটের নিরিখে পিছনে ফেলে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার প্রাপ্ত ভোটের পার্সেন্টেজের তুলনায় ২০১৪ সালে হঠাৎ করে বিজেপির ভোট পার্সেন্টেজ বেড়ে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট পার্সেন্টেজ কে ছাপিয়ে যায়। এর পরে ঘটে যায় এই এলাকার রাজনৈতিক পালাবদলের ইতিহাস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অধীন একাধিক উন্নয়নমূলক কাজ। শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেখানে জেলা পরিষদ তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত, ৯ টি পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত এবং ৯০ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল কংগ্রেসের অধীন সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪২ এর মধ্যে রায়গঞ্জ কে পাওয়ার আশা নিয়ে তার যোষনা ৪২ শে ৪২ যুক্তি সম্পন্ন। কিন্তু জেলা জুড়ে উন্নয়নের বাগান, দলবদলে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের একাধিক নেতৃত্বের তৃণমূল কংগ্রেসে আগমন এবং সংগঠন কে মজবুত করতে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং বিগত পাঁচ বছরে মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বন্দির ফলে জনগনের হয়রানি, গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদি জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকের আত্মহত্যার সংবাদ, জিএসটি চালু করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা সত্ত্বেও মোদির টানে আত্মহারা জনগণের উন্মাদনার আসল রহস্য কোথায় ও কেন। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে থেকেই সংবাদের শিরোনাম দেখা যেত প্রতিদিন এই রায়গঞ্জ লোকসভা এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসে কোথাও নেতৃত্বদের যোগদান, আবার কোথাও নেতৃত্বদের হাত ধরে শয়ে শয়ে হাজার হাজার মানুষ পতাকা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করছেন। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার উন্নয়নে সামীল হচ্ছেন। হতেই পারেন, হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ মানুষ সচক্ষে দেখছেন তাই। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনেই ঘটে গেল আভ্যন্তরীণ তিনটি জিনিস। এক মনোনয়নপত্র জমা করা নিয়ে , দ্বিতীয় ভোটের দিন। সাধারণ ভোটাররা, সাধারণ মানুষরা দেখলো এক ভয়াভয় সন্ত্রাস যা বাম জমানার সন্ত্রাস কেও হার মানিয়ে দেয়। আর তৃতীয় কারনটি যেটা বর্তমানে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি উন্মাদনার সুক্ষ্ম ধাপ। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠী কোন্দলের তীব্রতা। নিজেরাই নিজেদের বসে থাকা ডালে কুড়াল দিয়ে কুপিয়েছেন। এক এক জন নেতা অপরজন কে হারানোর জন্য উন্নয়নে সামীল হওয়া মানুষ ও দলীয় কর্মীদের বিজেপি কে ভোট দেওয়ার কথা গোপনে প্রচার করে। আর এই গোপন প্রচারের ভাইরাস যেভাবে সংক্রামিত হয়েছে তার নিদর্শন আজকের মোদির প্রতি এত উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ মানুষের বক্তব্য তারপরেও আছে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন জায়গার তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বের চাপা অহংকার, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও ব্যবহার, মানুষ কে মানুষ বলে গ্রাহ্য না করা, চালচলন ইত্যাদি যা সবকিছুই তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে প্রস্ফুটিত। সেই সাথে পুরানো ও নব্য তৃনমূলীদের এক সুবিশাল কমিউনিকেশন গ্যাপ। এই সকল থাবার নখের আঁচড়ে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার সাথে রায়গঞ্জ এলাকার বিস্তর উন্নয়নের সাথে সর্বসাধারণের হৃদয়কে আঁচড়িয়ে গিয়েছে। আর তার জন্যই একটু অ্যান্টিসেপটিকের আশায় বুক বেঁধে সাহস করে মোদির উন্মাদনায় সামীল হয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ২৩ মে নির্বাচনী ফলাফল যাইহোক না কেন উন্মাদনার ইতিকথা আগামী দিনকে অনেক কিছুই ইঙ্গিত করে।