চৈত্র এলেও করোনা সংক্রমনের আতঙ্কে উত্তরের চরক পূজা ও গাজনের দেখা নেই-
1 min readচৈত্র এলেও করোনা সংক্রমনের আতঙ্কে উত্তরের চরক পূজা ও গাজনের দেখা নেই
তপন চক্রবর্তী–কালিয়াগঞ্জ(উত্তর দিনাজপুর)–বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশে বরাবরের মত চৈত্র এলেও করোনার আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে এবার একদিকে যেমন সারা মাস ধরে চরকের ভক্তদের সাথে গাজনের বাজনা কানে আসেনি তেমনি উধাও চৈত্র সেলের বাজার। চৈত্রের প্রখর রোদে এবার ধরা দিচ্ছে সম্পুর্ন উল্টো ছবি।এবার চৈত্রের কাঠফাটা রৌদ্রে দেখা যাচ্ছে করোনার লকডাউনের কারনে হত দরিদ্র মানুষেরা সরকারি সাহায্য নিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ব্যাস্ত।গাজনের গান আর চরক পূজার আয়োজনে করোনার থাবা যেভাবে বসিয়েছে তাই এবার বোঝার উপায় নেই আর কয়েকটা দিন পরে যে সবার বহু প্রতীক্ষিত নুতন বছর আরো কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসছে তাতেই নববর্ষের নব আনন্দের কোন বিশেষ যে তাৎপর্য ছিল তা সবাই একরকম ভুলেই যেতে বসেছে।
তবুও জানা প্রয়োজন কবে থেকে চরক পূজা অথবা গাজন উত্তরবঙ্গে প্রচলিত হয়েছে তা বলা সম্ভব নয়।যদিও ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রক্ষিত দলিল অনুযায়ী ১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের আমলে ভারতীয় অংশে আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।এর থেকেই অনুমান করা যায় চরক পূজা বহু বছরেরই প্রচলিত পূজা ব্রিটিশ সরকার চরক পূজার ভয়াবহতা অর্থাৎ যন্ত্রণাদায়ক প্রথা থেকেই আইন করে বন্ধ করে দিয়েছিল।বিশিষ্ট ইতিহাসবিদদের দাবি দেশভাগ হবার পরে যখন পূর্ববঙ্গ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন জেলার সাথে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশে এসে বসবাস করতে শুরু করে তখন থেকেই চরক ও গাজনের প্রভাব বিস্তার লাভ করে।জানা যায় চরকপূজায় সমাজের অধিকাংশ মানুষই এই চরক পূজা বা গাজনের পূজায় সমাজের বেশি অংশের মানুষ জড়িত না হলেও পরোক্ষ ভাবে আজ তা অনেকটাই সার্বজনীন হয়ে উঠতে চলেছে।এই চরক পূজায় যে শুধু পিঠে বরশি গেঁথে বন বন করে ঘোরা তা নয়।চরক পূজার বিকেলে চরক মাঠে খুব অল্পবয়সী ছেলেরা লাল সালু পরিধান করে হাতে বড় দা নিয়ে এ মাথা থেকে সে মাথা দৌড়া দৌড়ি করাও চরক পূজার একটা বড় আকর্ষণ।চরক পূজা শাস্ত্র মতে পূজা না হলেও চরক পূজাকে সার্বিক উৎসব বললে ভুল বলা হবেনা।চরক পূজা সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করবার জন্য দায়িত্ব থাকে ছোট বড় সন্যাসীদের উপর।এই সমস্ত ছোট বড় সব সন্যাসীদেরই এক মাস ধরে অনেক সংযমের পরীক্ষা দিতে হয়।গোটা চৈত্র মাস নিরামিশ আহার করতে হয়।শিবের বা গাজনের মূল পুজা হয় শিবের।চরকে শিবের পূজাই প্রধান হলেও। ব্রম্মা বিষ্ণু,লক্ষী,গণেশ ,পার্বতীর পুজো ও করা হয়।সংক্রান্তির আগের দিন চরকের নীল পূজা করা হয়।চরক পূজায় একটি কাঠের পাটাতনের মধ্যে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি থাকে।একে সাধারণত পাট ঠাকুর বলা হয়ে থাকে।বেল,নিম বা সাল কাঠের কাঠ একটি গর্তে পুঁতে দেওয়া হয়ে থাকে।এর পর তাকে পূজা করা হয়।চরকের গর্তে পূজা করার পর চরকের আসল খেলা শুরু হয়।গর্তে পুঁতে থাকা এই কাঠের সাথে লম্বা কাঠের একটি দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকা তার সাথে অত্যন্ত সুচারু রুপে লাগানো হয় যা বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে।ঠিক সূর্যাস্তের সময় কাঠের দণ্ডের সাথে গাজনের সন্ন্যাসী পিঠে বাঁকানো লোহার কাটা বড়শি গেঁথে দেওয়া হয়।লম্বা কাঠের অপর পার্শের কয়েকজন একটি দড়ির সাহায্যে শূন্যে চক্রাকারে গাজন সন্ন্যাসীকে দ্রুত গতিতে ঘোড়ানো হয়ে থাকে।এই সময় উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হলেও উৎসুক দর্শকরা তা দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকে।লোক কথায় চরক উৎসব সেরে ঠিক পরের দিন বাবা শিব ঠাকুর মা পার্বতীকে কালতত্ব বুঝিয়ে থাকেন।চরক উৎসব সাধারণত নিম্নবর্গেরর মানুষ পালন করলেও এই গাজন উৎসবের মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে আছে এক গভীর দার্শনিক তত্ব যার নাম কালত্ত্ব।চরক পূজা বা গাজনের রূপ এ রাজ্যের মানুষ না দেখতে পেলেও বাবা শিবের কাছে সবাই প্রার্থনা করে বলছে বিশ্বের ত্রাতা বাবা মহাদেব তোমার অপার কৃপায় দেশবাসীকে করোনার হাত থেকে মুক্তি দাও।দেশের মানুষের মধ্যে থেকে করোনার আতঙ্ক দূর করে সবাইকে এই অশুভ শক্তির হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত কর।আসছে নববর্ষের প্রভাতে যেন করোনার হাত থেকে সবাই মুক্তি পেয়ে তোমার জয়গানে দেশবাসী ঘরে ঘরে গাজনের পূজা করে তোমায় নামযজ্ঞে সবাই মেতে উঠবে।